বড় খিদে পেয়েছিল সমীরণের। খুব লজ্জার সঙ্গে প্রায় মুখ লুকিয়ে আর এক মুঠো মুখে পুরতে গিয়ে হঠাৎ তার নজরে পড়ল একটা বুড়ো মতো অনশনকারী খুব জ্বলজ্বলে চোখে তাকে দেখছে। তাই মুড়িটা আবার ঠোঙার মধ্যে ছেড়ে দেয় সে। ঠোঙাটা মুড়ে হাতে ধরে রাখে।
অনশনকারীদের সংখ্যা জনা আষ্টেক হবে। তার মধ্যে পাঁচজন কাত বা উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। খুবই দুঃস্থ চেহারা সবার। যে বুড়ো মানুষটা তার দিকে চেয়ে ছিল সে খুব যত্নের সঙ্গে একটা বিড়ি ধরাল, তারপর মাথায় হাত দিয়ে বসে বিড়ি খেতে লাগল।
সমীরণের হাতের আঁজলায় ত্রিশ পয়সার মুড়ি হাতের ঘেমো ভাপে, ভেজা ছোলার সংস্পর্শে আর বাদলার বাতাসে মিইয়ে যাচ্ছে ক্রমে। পেট থেকে খিদেটা দু’হাত বাড়িয়ে আরও মুড়ি চাইছে, জিভটা কাঙালের মতো মুখের শূন্য অভ্যন্তরের আনাচ কানাচ থেকে এক-আধটা ছোলা মুড়ি বা বাদামের দানা খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছে। কিন্তু আটজন অনশনশিল্পীর সামনে বসে সে খায় কী করে?
বাইরে একদম জলপ্রপাতের মতো বৃষ্টি হচ্ছে এখন। রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, রাস্তা থেকে বৃষ্টির ছাট কাদার ছিটে নিয়ে গায়ে আসছে। ভিতরবাগে একটু সরে বসে সমীরণ। শুয়ে থাকা একটা লোকের পা তার গায়ে লাগে। লোকটা পা টেনে নেয়, তারপর একটু কোঁকানোর শব্দ করে উঠে বসে। বসেই বলে, শালার মলয়বাবু আজও এল না। ধুস! তারাপদদা, একটা বিড়ি দাও।
সেই বুড়ো লোকটা খুব কৃপণের মতো একটা বিড়ি শতরঞ্চির তলা থেকে বের করে দেয়।
সমীরণ পিছু ফিরে চেয়ে লোকটার বিড়ি ধরানো দেখছিল। লোকটা বিড়ি ধরিয়ে তার দিকে চেয়েই বলে ওঠে, সমীদা, না গো?
সমীরণও চিনতে পারে। পলাশির ফজলু। মীরাবাজারের হাইস্কুলে সমীরণ যখন নাইন টেন-এর ছাত্র ফজলু তখন সেভেন এইটে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ফজলু অবশ্য পড়া ছেড়ে দিয়েছিল।
সমীরণ বলে, তুই কী করছিস এখানে?
ফজলু বিড়িটা লুকিয়ে ফেলে দিয়ে বলে, আর কী! দেখছ তো। মলয়বাবু ছাটাই করেছে।
তাই বলে অনশন! মরে যাবি যে!– সমীরণ খুব চিন্তিত হয়ে বলে। সে নিজে অনশনের কথা ভাবতে পারে না। ভাল স্বাস্থ্যের দরুন তার খিদেটাও বেশি পায়। দেশের ছেলে ফজলু এরকম না খেয়ে থাকবে, সেটা সহ্য করে কী করে? বেফঁসে সে হাতের ঠোঙাটা বাড়িয়ে দিলে বলল, দুটো খা। এখনও তেমন মিইয়ে যায়নি।
ফজল আলী আঁতকে উঠে বলল, বলো কী! খাবার এখন আমার হারাম। তাছাড়া কষ্ট হয় না। এর আগেও বারকয়েক করেছি তো! একবার টানা সাত দিন অবধি।
সমীরণ ভারী অবাক হয়ে বলে, সাত দিন!
এবার বোধ হয় আরও বেশি হয়ে যাবে। মলয়বাবু খুব বেঁকে বসেছে। কারখানাই বেচে দিতে ঢাইছে। এর আগেও বেচে দিয়েছিল কয়েকবার। তবে সে ছিল বেচার নামে হাত বদল। মলয়বাবু আর নিলয়বাবু দুই ভাই। দুই ভাইয়ের দুটো কারখানা। যে যখন গোলমালে পড়ে তখনই সে তার। কারখানা আর একজনকে বেচে দেয়। মাঝখানে আমাদের যত দুর্দশা। কিন্তু এবার আর ভাইয়ে ভাইয়ে বেচাবেচি নয়, মায়োয়াড়ি পার্টি ধরেছে।
বৃষ্টি ধরে এসেছে। সমীরণ উঠে পড়ল। যাওয়ার আগে ফজলুকে বলে গেল, তোর বাড়িতে চিঠি লিখব। চাচাকে জানানো দরকার যে তুই না খেয়ে আছিস।
ফজলু হাসল। গরিব চাষি ঘরের ছেলে। খুব একটা ভাল খাওয়া-পরা জোটেনি কোনওদিন। তবে সানকি ভরা ভাত নুন লংকা দিয়ে হলেও পেট পুরে খেয়েছে। হাসিটা দেখে বড় কষ্ট হল সমীরণের।
তিনতলার অফিসঘরের দরজাতেই সুখন দাঁড়িয়ে। তার চোখে মুখে আতঙ্কের ভাব। সমীরণকে দেখেই বলে ওঠে রায়বাবুর মেয়ে সব ফাইল-টাইল দেখছে। আপনার খোঁজ করছিল। সামালকে বাতচিত করবেন।
সমীরণের বুকটা একটা ডিগবাজি খেল। ভয়ে নয়, উত্তেজনায়। রায়বাবুর মেয়েকে সে দেখেছে। একটু রোগা, একটু শ্যামলা, দোষের মধ্যে ওইটুকুই। তাছাড়া গোটাগুটি ভারী লোভনীয় মেয়ে। বড় বড় চোখ, উড়োখুড়ো চুল, ফাঁক হয়ে থাকা দুটি আঙুলের মতো টসটসে ঠোঁট, দাত সাদা এবং ঝকঝকে, কথাবার্তা খুব মোলায়েম এবং গলার স্বর ইস্পাতের মতো ঠান্ডা। সে এমনভাবে সাজে যাতে তাকে একটু রোগে-ভোগা রোগে-ভোগা দেখায়। কাউকে পাত্তা দেয় না। বহু ছেলে-ছোকরার সঙ্গে ঘোরে। হোটেলে গিয়ে নাচে। সারাদিন গাড়ি দাবড়ে বেড়ায়, অজস্র অদরকারি জিনিস কেনে। নাম মন্দা।
সমীরণ জানে, এ মেয়ের সঙ্গে তার ভাব ভালবাসা হওয়ার নয়। কিন্তু যতক্ষণ খাস, ততক্ষণ আশ। তার বুকটা তাই ডিগবাজি দিল।
অফিসের ঘরটা বেশ বড়। সেই বড় ঘরের মধ্যে আবার পার্টিশন করে দুটো ছোট ঘর বানানো হয়েছে। একটা রায়বাবুর, অন্যটা আচার্যিবাবুর। রায়বাবুর ঘরটাই ভাল। তাতে এয়ারকুলার আছে, কার্পেট আছে, ঘষা কাঁচের শার্সি আছে। রায়বাবু না থাকলে ঘরটা তালাবন্ধ থাকে।
সমীরণ ঘরে ঢুকে দেখে, মন্দার বাঁ হাতে ফোন, মুখে খিলখিল হাসি। কথাবার্তা সব চোখা ইংরিজিতে হচ্ছে। সেন্টের গন্ধে ম ম করছে বাতাস। মন্দা ছাড়া ঘরে আর একটা লোকও আছে। লম্বা, ফরসা, চালাক-চালাক চেহারা, লম্বা চুল, গোঁফ, সামান্য দাড়ি। বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছে গম্ভীর মুখে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয়।
মেয়েরা ফোন ধরলে সহজে ছাড়ে না। মন্দাও ছাড়ছে না। সমীরণ দাঁড়িয়ে থাকে। থেকে থেকে। পা ধরে যায়। খেয়াল করে একবার সে রুমাল বের করে ঠোঁট থেকে মুড়ির গুঁড়ো মুছল, ঘাম মুছল। তাতে তাকে কতটা সুন্দর দেখাল কে জানে। মন্দা তার দিকে মাঝে মাঝে অবাক হওয়া চোখে তাকাচ্ছিল বটে, কিন্তু সে তাকানোর মধ্যে দৃষ্টি নেই। মন্দা এখন ফোনের অপর পারের লোকটিকে দেখছে। ছোকরাটা একবার ম্যাগাজিন থেকে মুখ তুলেছিল বটে কিন্তু সেও সমীরণকে দেখল না ভাল করে।