জয়তী দেয়। বৌধায়ন এক চুমুক খেয়ে মুখ বিকৃত করে বলে, এত মিষ্টি কেন?
ওমা উপোসি শরীরে জল খেলে মিষ্টি লাগবে না? বোকা আছে মাইরি! এ তো সবাই। জানে!– জয়তী জবাব দেয়।
বৌধায়ন সন্দেহের চোখে চেয়ে বলে, হকি খেয়ে বা মৌরি চিবিয়ে জল খেলে মিষ্টি লাগে বটে, তা বলে উপোস করলেও লাগবে?
বড় বড় চোখে চেয়ে জয়তী বলে, আমাকে যা বলার বললে, অন্য কাউকে বোলো না যেন। লোকে হাসবে।
বৌধায়নের আর বাধা হল না। সে পুরো আধসেরি গ্লাসের জল ঢক করে খেয়ে নিল। বলল, আর একটু।
জয়তী দেয়। বৌধায়ন খেয়ে বিড় বিড় করে বলে, গ্লুকোজ। গ্লুকোজ! নিশ্চয়ই গ্লুকোজ।
সন্ধে হতে না হতেই নতুন করে ভিড় জমে বাড়িতে। আবার খিটখিট, কান্নাকাটি হাতাপিতি।
বৌধায়ন নীরবে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে তাকে জল খাইয়ে যায় জয়তী। ডাক্তার এসে প্রেসার মাপে, হার্টবিট দেখে নাড়ি পরীক্ষা করে।
রাত্রিবেলা জয়তী ঘোষণা করল, অনশনে ওষুধ বারণ নয়।
বৌধায়ন বলল, ওষুধ? আমি ওষুধ খাব কেন?
জয়তী গম্ভীর হয়ে বলে, ডাক্তার বলেছে তোমার হার্ট ভাল নয়।
যাঃ।
মাইরি, কালীর দিব্যি।
খুবই সন্দেহ হতে থাকে বৌধায়নের। কিন্তু সে অসুখকে ভয় পায়। ভীষণ ভয় পায়।
তাই রাত্রিবেলা জয়তী তার নাক টিপে ধরে, কৌশলে হাতের পাতায় চোখ আড়াল করে মুখে ওষুধ ঢালতে থাকে।
এত বড় ডোজের ওষুধ বৌধায়ন জীবনে খায়নি। গিলছে তো গিলছেই। আর বেশ মিষ্টি ও সুস্বাদু ওষুধ।
কী খাওয়ালে বলো তো? সত্যি ওষুধ?
মাইরি, কালীর দিব্যি।
কী নাম ওষুধটার?
ভিটোলাস।
শিশিটা দেখাও তো।
জয়তী গম্ভীর মুখে একটা শিশি এনে দেখায়। ওষুধের জগতের কোনও খবরই বৌধায়ন রাখে না। তাই শিশিটা সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে বলল, আমি ঘুমোব। তোমরা যাও।
বিড়বিড় করে বৌধায়ন বলে, ইউ উইল বি অ্যানাদার ফার্স। অ্যানাদার ফার্স।
জয়তী মুখ টিপে হাসে।
.
১৪.
অনশনের দুশো দিন পূর্ণ করে ফজল আলী উঠল।
এতই শীর্ণ যে প্রথমে তাকে ভাল করে বোেঝা যাচ্ছিল না। শুকনো হাড়ের ওপর চামড়াটা কে যেন বিছিয়ে রেখেছে অযত্নে। দুটো চোখের গুহার ভিতরে নিভন্ত ব্যাটারির টর্চবাতি জ্বলছে।
টেলিভিশন ক্যামেরায় প্রথমে তার ছবিই এল না। দর্শকরা ঘন ঘন টেলিফোন করতে লাগল, ফজল আলী কই?…গুরুকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
ক্যামেরার লেন্সের জোর বাড়ানো হল অ্যাঙ্গেল বদলানো হল। অবশেষে টেলিভিশনে প্রেতশরীরের মতো, অশরীরীর মতো ভেসে উঠল ফজল আলীর ছবি।
সারা পৃথিবী ফেটে পড়ল হর্ষধ্বনিতে।
ফজল আলী সামান্য হাসে এবং সবাইকে আদাব জানিয়ে তার ভুতুড়ে নাকিস্বরে বলে, খোদার মেহেরবানি। আমি বেঁচে আছি। বেঁচে থাকব।
সারা বিশ্বের টি ভি নেটওয়ার্কে কোটি কোটি মানুষ সেই কথা শুনে জয়ধ্বনি দেয়।
ফজল আলী উঠে দাঁড়ায়। হাত তুলে বলে, অনশন একটা শিল্প। ভাইসব পেটে পাথর ভরে নিতে হয়, পেটে দুর্গ বানিয়ে নিতে হয়। মনে রাখতে হয়, খাদ্যবস্তু আমাদের হারাম।
ফজল আলী হাঁটতে থাকে। ক্যামেরা ধাওয়া করে তাকে। মাইক্রোফোন চলে সঙ্গে সঙ্গে।
ফজল আলী ধীর স্বরে বলতে থাকে, মানুষকে আমি ঘরে ঘরে গিয়ে শেখাব কী করে খাদ্যবস্তু বর্জন করে বেঁচে থাকতে হয়। বেঁচে থাকতেই হবে, খাওয়াও জুটবে না, এ দুটো জিনিস মেলাতে পারলেই জীবন বড় সুন্দর।
ফজল আলী রাস্তায় নামে। লক্ষ লক্ষ লোক হাঁটে তার সঙ্গে। গর্জন করে জয়ধ্বনি দেয়।
ফজল আলী বলে, খোদা মেহেরবান। আমাদের তিনি ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। ভাইসব সেই ইচ্ছাশক্তিই আমাদের মূলধন, আমাদের হাতিয়ার। এই যে হাত-পা দেখছেন, এই যে গায়ের চামড়া, এই চোখ আর ওই দেখুন আল্লার আলো, বাতাস মাটি, ইচ্ছাশক্তিবলে ওই আলো বাতাস আর মাটি থেকে আপনার হাত, পা, চামড়ার প্রতিটি ছিদ্র গাছের মতো টেনে নিতে পারে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন। প্রথমে একটু অভ্যাস, কিন্তু ক্রমে ক্রমে…
ফজল আলী এগোতে থাকে।
বুড়ো হরিদেব আর নিত্যপদ ধরাধরি করে চৌকিটা রাস্তার ধারে পেতে দিয়েছে। শামিয়ানার অভাবে ওপরে মশারিটা চালি করে টাঙাননা।
চৌকিতে সমীরণ শুয়ে আছে। একধারে নিত্যপদ তার শেলেটে ‘অনশনের আজ দশ দিন’ লিখে টাঙিয়ে দিয়েছে। দেখার জন্য বেশ ভিড় হচ্ছে আজকাল।
হরিদেব আর নিত্যপদ পালা করে হাতপাখা নেড়ে হাওয়া দেয়, সমীরণকে। চৌকির আশেপাশে ঘুরঘুর করে।
নিত্যপদ জিজ্ঞেস করে, তুমি পারবে বাবা?
হরিদেব খুব হেসে বলে, তুই পারবি?
নিত্যপদ বলে, পারব না কেন! তবে দাদার চার নম্বর বউটা ভাল, বুঝলে বাবা। খেতে দেয়। এর পরের মাগিটা যদি খারাপ হয় তবে তো খেতে দেবে না। তখন করব?
হরিদেব ভেবে পায় না সে আজ খেয়েছে কি না। গতকাল কি কিছু খেয়েছিল? কিছু মনে পড়ে না।
নিত্যপদ আপনমনে মার্বেল খেলে। হরিদেব বসে বসে ঢোলে।
.
এক গভীর রাতে সমীরণের মাথায় কে হাত রাখল।
সমীদা গো! ও সমীদা!
কে? রায়বাবু? মন্দা!–বলে অনেক কষ্টে সমীরণ চোখ খোলে। প্রেতের মতো শীর্ণ একটা লোককে দেখে শিয়রে। চমকে ওঠে। শমন এল নাকি?
শীর্ণ লোকটা হেসে বলে, না গো! আমি ফজলু। পারছ সমীদা?
সমীরণ শীর্ণমুখে হাসে, পারছি। বুঝলি! একটু একঘেঁয়ে লাগে। তবে পারছি। হাত-পা চামড়া দিয়ে গল গল করে ভিটামিন ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে। প্রোটিন আসছে। ক্যালসিয়ামও।