বাবার সঙ্গে তার দেখা খুব কম। প্রায়দিনই হয় না।
একদিন রাতের বেলা সিঁড়িতে মুখোমুখি হল। সাধারণত তাদের বাক্যালাপ নেই। একে অন্যকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু বাবার চেহারাটা খুব ভাল দেখল না মন্দা। মুখে চোখে কেমন ভ্যাবলা ভাব, চামড়া ঝুলে পড়েছে। সেই হাসিখুশি আমুদে মানুষটা আর নেই।
সে থমকে দাঁড়াল। রায়বাবুও দাঁড়ালেন।
প্রথমে কিছুক্ষণ কথা নেই। তারপর মন্দাই নিজে থেকে জিজ্ঞেস করে, তোমার শরীর খারাপ?
বড় দুশ্চিন্তা।
কেন?
রায়বাবু খানিকটা আকুল স্বরে বললেন, তোর তো ব্যাবসার খুব শখ। মাথাও আছে। দেখবি চেষ্টা করে? আমরা তো নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি।
কেন?
কর্মচারীরা কেউ মানছে না আজকাল। কাজ হচ্ছে না কোথাও।
মন্দা নিষ্ঠুর হেসে বলে, তাই মেয়ের ফেমিনিন চার্মকে কাজে লাগাতে চাইছ?
রায়বাবু রেগে গিয়ে বলেন, তুই গোল্লায় গেছিস। তাই যা। কিছু বলতে যাওয়াই ভুল।
মন্দা ভারী মজার হাসি হেসে বলে, প্রবলেমটা কী?
ফজল আলী।
মন্দার সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। ভিতরটা ধুয়ে যায় এক রহস্যময় আনন্দে।
হঠাৎ রায়বাবু বললেন, সমীরণ নাকি তোকে খুব বিরক্ত করত?
মন্দা সমীরণকে মনে করতে না পেরে বলে, কে সমীরণ?
ওই যে বডিগার্ড ছেলেটা।
না তো! বরং হেলপ করেছে।
সুখন বলছিল।
কী?
খুব মাখামাখির চেষ্টা করত তোর সঙ্গে! যাই হোক, ওকে ছাড়িয়ে দিয়েছি।
বেচারা। বলে হাসল। তারপর বলল, কিন্তু দুনিয়াশুষ্টু ছেলেছোকরা তো তোমার কর্মচারী নয়। ক’জনকে ছাড়াবে?
রায়বাবু তা জানেন। তাই লাল মুখে মেয়ের সামনে থেকে সরে গেলেন তাড়াতাড়ি।
.
১৩.
বৌধায়নের অনশনের আজ দ্বিতীয় দিন।
প্রথম দিনটায় কেউ তেমন খবর পায়নি। সকালে বৌধায়ন গুল ঝাড়ল, শরীর খারাপ। খাব না।
শুনে বাবা ডাক্তার ডাকালেন। ডাক্তার এসে ঘণ্টাখানেক বসে রইলেন। অনেক ডাকাডাকিতেও বৌধায়ন বাথরুম থেকে বেরোল না। তারপর সারাদিনই মা, দাদা, বাবা খিটখিট করতে লাগল। বৌধায়ন মটকা মেরে পড়ে রইল।
বিকেলবেলা জয়তী ঘোষণা করল, বুধোর শরীর-টরীর খারাপ কিছু নয়। ফজল আলীর মতো অনশন করছে।
সেই শুনে সকলের চোখ কপালে।
আজ দ্বিতীয় দিন বেলা যত বাড়ছে তত বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজন দেখতে আসছে বৌধায়নকে।
কী লজ্জা।
অবশ্য লজ্জার ভাবটা তার মুখে খেলছে না তেমন। গত রাত্রি থেকেই কান ভোঁ ভোঁ করছে। শরীর মিশে গেছে বিছানায়। চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছে না। গলার স্বর ক্রমে ক্ষীণ হচ্ছে।
সকালবেলাতেই এক গোছা রজনীগন্ধা নিয়ে এল মন্দা। হেসে বলল, তোমার এক দিনের অনশন ফজলের বিশ দিনের সমান।
ঠাট্টা করছ?
না গো! ফজল তো গরিব ঘরের ছেলে, না খেয়ে অভ্যাস আছে। আর তুমি জীবনে এক বেলাও না খেয়ে থাকোনি, তাই তোমার অভ্যাস অন্য রকম।
বৌধায়ন ক্ষীণকণ্ঠে বলে, আমার মনে হচ্ছে, তুমি এখনও ঠাট্টা করছ। রজনীগন্ধা ফেরত নিয়ে যাও।
লক্ষ্মীটি।
খুবই হতাশ হয় বৌধায়ন। সারা জীবন ধরে সে নানা সৎ কাজের চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত কোনওটাই হচ্ছে না। সে তত বেশি কিছু চায় না, শুধু এই মানবসমাজের কল্যাণ চায়।
সুব্রত মন্দার একটু পরেই এসে বলল, কংগ্র্যাটস বৌধায়ন।
ইয়ার্কি কোরো না।
করছি না। শুধু বলি এখন অনশন প্র্যাকটিশ করাটা বোকামি।
বৌধায়ন দুর্বলতার মধ্যেও কেঁঝে উঠে বলে, কেন?
বোঝো না? ফজল আলী পৃথিবী থেকে খাদ্য সমস্যা তাড়িয়ে দিল তো? এখন গরিব-গুৰ্বোরা কায়দাটা শিখে নিয়ে খাদ্য বর্জন করত শুরু করবে। আর তখন পৃথিবীতে রাশি রাশি খাবাব থাকবে উদ্বৃত্ত। ফসলের খেত হয়ে যাবে আগাছার জঙ্গল। খাবারে ধুলো পড়বে, খাবার পচবে। সুতরাং সে সব খাবার নিয়েও দেখা দেবে গ্রেট প্রবলেম। কে খাবে তুমি আমি ছাড়া?
বৌধায়ন চোখ বুজে বলল, তোমার রজনীগন্ধা ফেরত নিয়ে যাও।
আমি রজনীগন্ধা আনিনি যে!
তাহলে কী এনেছ?
ওনলি গুড উইশেস।
ফেরত নিয়ে যাও।
মা সারাদিন পাশে বসে হাতাপিতি করে দিচ্ছে। পিসি, মাসিরা এসেও হাতাপিতি করছে। এক কাকিমা এসে এক রাউন্ড কেঁদে গেল। মাও কাদছে চেপেচুপে।
রেনি পার্ক থেকে অফিস কামাই করে বড়দা এসেছে সপরিবারে। এসে তক ইংরেজিতে নানা রকম মার্জিত গালাগাল দিচ্ছে তাকে। ইররেসপনসিবল, ভ্যাগাবন্ড ফ্যানাটিক সিউডো হিরো…
দাঁতে দাঁত চেপে বৌধায়ন পড়ে রইল। কিন্তু তাইতেই কি নিস্তার আছে? নৃত্যনাট্য দলের সঙ্গে দিল্লি গিয়েছিল নয়না। সেদিন সকালে ফিরে এসেই সোজা বৌধায়নের ঘরে এবং বুকের ওপরে। একরাশ চোখের জল ফেলে বলল, কেন মরতে চাইছ? আমি তো তোমাকে রিফিউজ করিনি।
বৌধায়ন বিড় বিড় করে বলে, না, আমিই করছি।
আস্তে বলা হলেও শুনতে পেল নয়না। ঋজালো চোখে চেয়ে বলল, তুমি এই রকম?
আরও খারাপ। বলে বৌধায়ন।
নয়না তারপর আবার কাঁদে! অনেকক্ষণ বসে থাকে।
দুপুরে ঘর খানিকটা ফাঁকা। জয়তী টুক করে এসে তার মাথায় হাত রেখে বলল, ওমা! জল খাচ্ছ না যে!
জল খায় নাকি?
খায় না? জল কী গো? সরবৎও চলে।
ইয়ার্কি কোরো না।
মাইরি বলছি। আমাদের পাড়ায় অনশন হয়েছিল একবার। অত কী, গাঁধীও জল খেতেন।
বৌধায়ন বিশ্বাস করে না।
কিন্তু জয়তী ঘুরঘুর করতে থাকে।
বিকেলের দিকে বৌধায়ন মাথা তুলে বলে, সত্যি জল খায়?
জয়তী ম্লান মুখে বলে, আমি তোমাকে মিথ্যে কথা বলব?
একটু ভেবে বৌধায়ন বলে, এক সিপ জল দাও তো তাহলে!