সমীরণ চোখ বুজে ফেলে। পেছন থেকে ভিড়ের ধাক্কা খেয়ে সে উবু হয়ে পড়ে। তারপর বহু লোক তাকে নির্দয় ভাবে মাড়াতে থাকে। তাদের পায়ে পায়ে কাদার মতো ক্যাতকাতে হয়ে যেতে থাকে সমীরণ।
প্রাণপণে হামাগুড়ি দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। প্রথমে পারে না। তারপর হাজার মানুষের পায়ের গরাদ ভেদ করতে থাকে সে। অতি কষ্টে। ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে এগোতে থাকে। বুকের বেলুন চুপসে গেছে। দম পায় না। তবু ব্যায়ামের সুফলে সে মরেও যায় না তাতে। এগোয়।
এগোতে এগোতে সে এক সময় ফজল আলীর পালঙ্কের তলায় ঢুকে যায়।
খানিকক্ষণ সেখানেই ঘাপটি মেরে থাকে সে। তারপর চুপিসারে পালঙ্কের ওধার দিয়ে মুখ বার করে। এদিকটায় কেউ নেই। ফুলের পাহাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে সে চাপা স্বরে ডাকে, ফজলু! ফজলু রে!
ফজলু ক্ষীণ ভুতুড়ে নাকি স্বরে বলে, কে? মলয়বাবু?
না রে। আমি সমীদা।
সমীদা? কী বলেছিলাম তোমায়? দেখলে তো!
হচ্ছে ফজলু?
হচ্ছে মানে? হয়ে গেছে। বেশ তাকত পাচ্ছি এখন।
বড্ড রোগা হয়ে গেছিস যে!
তা তো হবই। তবে এইভাবেই থেকে যাব। আর কোনও কষ্ট নেই।
আর কোনওদিন কিছু খাবি না ফজলু?
খাওয়ার সঙ্গেই তো লড়াই। আমি লড়াই জিতে গেছি।
তোর কত নামডাক হয়েছে রে ফজলু! কত মেয়েরা আসছে! আমার মালিকের মেয়ে পর্যন্ত তোর গলায় মালা দিয়ে গেল!
ফজলু নাকিস্বরে আস্তে আস্তে বলে, আমার মালিক শেষ পর্যন্ত এল না সমীদা!
আর আসে? সে তোর নামডাক দেখে ভয়ে পালিয়েছে।
কারখানাটা তো তবে আর খুলবে না।
না খুলুক। তোর আর তা দিয়ে কী হবে? তুই তো বড়লোক হয়ে গেলি। কত টাকা পড়েছে দ্যাখ।
তা বটে।–বলে ফজলু পা দিয়ে একটা একশো টাকার নোটের মালা খাট থেকে ফেলে দিয়ে বলে, ফুলের মধ্যে অনেক ভিটামিন, বুঝলে? আমার শরীর ফুল থেকে চোঁ চোঁ করে ভিটামিন মেরে দিচ্ছে। কিন্তু টাকাগুলো কোনও কাজের নয়। বড্ড শুকনো।
কাগজ তো! ওর আর রসকষ কোখেকে আসবে।
টাকা যে কাগজ তা এই প্রথম বুঝলাম সমীদা। বড্ড শুকনো জিনিস। টাকা থেকে রস টানতে পারি না। কেন যে দেয় লোকে এগুলো!
বড্ড দুর্বল হয়ে গেছিস রে ফজলু।
না গো! এখন ফের বল পাচ্ছি। আর দু’-একদিনের মধ্যেই উঠে পড়ব। হাঁটব চলব, দৌড়ব। দেখো। উঠতে তো হবেই। বিদ্যেটা সবাইকে শেখাতে হবে যে? মস্ত ইস্কুল খুলব, ইউনিভার্সিটি খুলে ফেলব। দেখো।
.
১২.
এখনও কে পিছু পিছু আসে মন্দার? এখনও কে পিছু নেয় তার?
মন্দা পিছু ফিরে তাকায় না। তার সারা শরীর কণ্টকিত হয় এক রহস্যময় অনুভূতিতে! তার মনে হয়, পিছু ফিরলেই সে দেখতে পাবে ফজল আলীকে।
একা ঘরে শুয়ে ঘুমোবার আগে প্রতি রাত্রেই তার মন বলে, আজ তুমি ফজল আলীকে স্বপ্ন দেখবে মন।
.
মন, তুমি আজকাল কেমন হয়ে গেছ! একদম পাত্তা দাও না আমাদের!-সুব্রত এক বিকেলে ভিক্টোরিয়ার মাঠে বসে বলল।
মন্দা ঘাসের গোড়া চিবিয়ে বলে, কোনওদিন দিতাম কি?
তা বটে।-বলে সুব্রত হোঃ হোঃ করে হাসে।
হেসো না।
কেন?
আজ ফজল আলীর অনশনের নিরানব্বই দিন পূর্ণ হল। কাল একশো।
সুব্রত দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বলে, ইয়েস। সমস্ত দেশের হার্টবিট থেমে আসছে।
.
টেলিফোনে মৃদুল ডাকে।
মন, তোমার জন্য একটা বিকেল রেখে দিয়েছি আলাদা করে। আসবে সেদিন? শুধু তুমি আর আমি?
ইচ্ছে করছে না মৃদুল।
কেন মন? আমার কি আর কোনও চার্ম নেই?
ইউ ওয়্যার অলওয়েজ সো চার্মিং।
তবে?
আমারই আর সেই চার্ম নেই।
মৃদুল দুঃখিতভাবে বলে, পৃথিবীরই আর কোনও চার্ম রইল না মন।
কেন?
দ্যাট ডেমন, দ্যাট ফজল আলী! যদি সাকসেসফুল হয় মন, ও যদি পৃথিবী থেকে ফুড প্রবলেম লোপাট করে দেয় তাহলে আর কোনও কমপিটিশন থাকবে না, প্রোডাকশন থাকবে না, টাকার দাম মাটি হয়ে যাবে। কত ইন্ডাষ্ট্রি বন্ধ হয়ে যাবে জানো? অ্যান্ড উই উইল বিকাম জবলেস!
মন্দা মৃদু স্বরে বলে, ফজল আলীর জয় হোক।
.
ওয়াশিংটন ডি সি থেকে সুবীরের চিঠি আসে, মন, এ নিয়ে চারখানা চিঠি গেল। জবাব দাওনি। রাগ করেছ?… ওখানে ফজল আলী নামে কে একজন অনশন কবছে, দেখেছ তাকে? এখানে রোজ টেলিভিশনে তার ছবি। কী ভীষণ কাণ্ড বলল তো। ওয়াল স্ট্রিটের কর্তাদের মাথায় হাত। তাদের ভয়, এশিয়া, আফ্রিকা আর সব গরিব দেশে তাদের ব্যাবসা ড়ুবে যাবে। এ কি সম্ভব? আমাকে ভুলো না লক্ষ্মীটি।
মন্দা চিঠি ছিড়ে ফেলে দেয়।
.
বলুকে ডাকতে হয় না। সে আপনিই আসে। শীত পড়েছে, তাই মনের সুখে এখন ওর স্যুট পরার কথা। কিন্তু পরেনি। টেরিটনের প্যান্টে গোঁজা সাধারণ শার্ট, টাইটাও নেই।
বলে, গজব। সব গজব হয়ে গেল মন।
কী হল?
ব্যাবসা। লাখো টাকা জলে যাবে।
কেন?
তুমি ব্যাবসা বোঝো না। লোকে ভুখা না থাকলে কী জন্যে কাজ করবে? ব্যাবসা চলবে কীসে? ফজল আলী হ্যাজ গিভন দা ওয়ার্ল্ড দা বিটারেস্ট স্লো। …চলল, মাল খাব।
না বল। আমি খাচ্ছি না।
ওঃ, দ্যাট হেডেক অফ ইয়োরস?
বলে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থাকে বলু। তারপর বলে, ব্যাবসা ব্যাবসা করে গান ভুলে গেছি, বই পড়া ভুলে গেছি! এখন ভাবছি কী জানো?
কী?
ব্যাবসা তো গজব। তাই সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে এখন থেকে প্রাণভরে রবীন্দ্রসংগীত গাইব। বই। পড়ব এন্তার। আবার যৌবনটা ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে বাঁচব কী নিয়ে?
.
বাবা ফিরে আসবার পর থেকে মন্দা আর অফিসে যায় না।