ঢ্যাঙা একটা লোক একটা টেবিলের ওপর উঠে হাতে মাইক চেপে আবৃত্তি করে, প্রতিজ্ঞা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, লেখা হয় যেন আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ!
গুরু! গুরু!
আই লাভ ফজল আলী…
আমাদের নেতা ফজল আলী…
জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!
সেই প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে সমীরণ পাগলের মতো সুড়ঙ্গ খুঁড়তে থাকে। তার গায়ে এখন লক্ষ হাতির জোর। মুখে চোখে বাঘের হিংস্রতা। পিছন থেকে তার একটা হাত ধরে রেখেছে মন্দা। গাঁটছড়া বেঁধে তারা এগোচ্ছে।
খানিকটা ভিতরে গিয়ে মালার লাইন পাওয়া গেল। কিন্তু সে লাইনেরও কোনও স্থিরতা নেই। ঘোড়সওয়ার পুলিশ আর ব্যাটন আপনো সেপাইরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। মুহুর্মুহু ভেঙে যাচ্ছে, বেঁকে যাচ্ছে, জট পাকাচ্ছে মালার লাইন।
লাইনে যুবতী মেয়েরা মালা হাতে ঘেমে একাকার। বহু লোকের হাতে দশ আর একশো টাকার নোটের মালা ঝুলছে। একজন মারোয়াড়ি পাড়ার মালা দু’ হাতের আঁজলায় ধরে টাল সামলাচ্ছে।
একজন মেয়ে আর একটা মেয়েকে বলে, তাপসী, তোর মালা কই?
আমি সোনার হারটা দেব গলা থেকে খুলে। তিন ভরির হার।
ভিড় চিরে টেলিভিশনের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। গরমে, ঘামে, টকটকে লাল হয়ে আছে একগাদা সাহেব-মেম।
দুটো বাঁশের গায়ে লটকানো মস্ত এক ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা: ফজল আলীর অনশনের আজ ৪০ দিন।
বিশ্বাস হয় না। কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না সমীরণের। তবে কি ফজলু পেরে গেল? পলাশি গাঁয়ের সেই ন্যালাখ্যাপা ছেলেটা কি সত্যিই পাল্টে দিল দুনিয়ার ভোল?
মন্দা হাতে মিষ্টি একটু চাপ দিয়ে বলল, মালা শুকিয়ে যাচ্ছে। প্লিজ।
হ্যাঁ, সব পারে। সব পারে সমীরণ। মিষ্টি হাতটায় নিজের হৃদয়ের তরঙ্গ পাঠিয়ে চেপে ধরে সমীরণ। বলে, এই তো এসে গেছি। আর একটু।
ফজলু যে তার বন্ধু, তার দেশের ভাই, তা মন্দাকে বলতে সাহস পায়নি সমীরণ। এখন কে না বিখ্যাত ফজল আলীর বন্ধু হতে চাইবে? সমীরণ বোকা নয়।
আওয়াজ ওঠে, জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর…
ফজল আলী আমার ভাই, তোমার ভাই..
ম্যারাপে ঢুকবার মুখে লাইনটা জট পাকিয়ে ভিড়ের চাপে ফোঁড়ার মতো ফুলে উঠছে এক জায়গায়। ফুলতে ফুলতেই ফাটবে।
সমীরণ ভিড় চেনে। তাই সে সেই ফোলা জায়গাটার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। তা করতে গিয়ে অবশ্য পুলিশের ঘোড়া লালাসমেত একটা প্রকাণ্ড নিশ্বাস ফেলে তার ঘাড়ে। একটা সেপাই তার পেটে ব্যাটনের গুতো চালায়।
মন্দাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে এই আমলাতান্ত্রিক অত্যাচার সহ্য করে সমীরণ।
লাইনের ফোঁড়াটা গেলে দেওয়ার জন্য সমীরণ আচমকাই লাইনের একটা বেটাল লোককে হাত ধরে হ্যাচকা টানে সরিয়ে আনে।
নিখুঁত কাজ। ফেঁড়াটা গলে গিয়ে গলগল করে পুঁজের মতো মানুষজন বেরিয়ে আসে টাল বেসামাল হয়ে। গড়াতে থাকে লোকেরা, মেয়েরা। কাটা গাছের মতো পড়ে যায় জোয়ান শরীর। ধুলোয় মালায় মাখামাখি। ঘোড়সওয়াররা পর্যন্ত সেই লঙ্কাকাণ্ড দেখে পিছিয়ে যায়।
মন্দাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে সমীরণ ম্যারাপের ফটকে ঢুকে পড়ে চোখের পলকে।
গদিওয়ালা একটা মস্ত পালঙ্কের ওপর কেবল ফুলের, টাকার আর খাবারের তূপে দেখা যায়। চারিদিকে ঘিরে আছে শক্তসমর্থ পাহারাদার এবং পুলিস।
মন্দা উত্তেজিতভাবে বলে ওঠে, কোথায় ফজল আলী?
কী আকুলতা মন্দার গলায়। একবার অভিমানভরে মন্দার দিকে তাকায় সমীরণ। মিষ্টি হাতটা তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে মন্দা। স্বয়ম্বরার মতো দুই হাতে মালা ধরে উৎকণ্ঠ আবেগে বলছে, কোথায় ফজল আলী? কোনজন ফজল আলী?
পাহারাদারদের মধ্যে একজন হাত বাড়িয়ে বলে, মালা আমার হাতে দিন।
মন্দা তীব্র স্বরে বলে, না না! আমি নিজে দেব।
সেপাইরা চেঁচায়, ভিড় করবেন না। দাঁড়াবেন না। চলতে থাকুন। এখনও অনেকে লাইনে আছে।
বিশাল ম্যারাপের ভিতরেও হাজার লোকের ভিড়। একজন করুণ স্বরে বলে, একবার চোখের দেখা দেখব, একবার…
অবশেষে দেখা যায় ফজলুকে। ফুলের প্রতিরোধ ভেঙে মালার দেয়াল সরিয়ে ক্ষীণ একটা কঙ্কালের হাত বেরিয়ে আসে। বালিশের ওপর আস্তে পাশ ফেরে ফজল আলীর মমির মতো বিশুষ্ক মুখ।
জনতা গর্জন করে ওঠে, ফজল আলীর মৃত্যু নেই..ফজল আলী যুগ যুগ জিয়ো… গুরু। গুরু!
বাইরে থেকে আবৃত্তিকারের গভীর কণ্ঠস্বর আসতে থাকে, উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।… (আর একটা! আর একটা!)… বল বীর, চির উন্নত মম শির, শির নেহারিয়া নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির…।
হঠাৎ ওভারহেড ল্যাম্প থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় সাদা ঘর সাদা ফরসা হয়ে যায়। চালু হল টেলিভিশন ক্যামেরা। লাল সাহেবরা ছোটাছুটি করে পজিশন নেয়।
সেপাই আর পাহারাদাররা সামান্য অন্যমনস্ক ছিল, সেই মুহূর্তে হাজারটা যুবতী কিশোরী মেয়ে প্রতিরোধ ভেঙে ছুটে যায় পালকের কাছে। তাদের বিস্ময়ের কিচির মিচির শব্দ ওঠে… দেখেছিস! এখনও কী ভাইটালিটি?..আই লাভ ইউ ফজল!…ফজল ডার্লিং।…ফজল, আমার নাম মিতা, আমাকে মনে রেখো!….
একটি তরুণী সুন্দরী মেম ফজলের শুকনো ঠোঁটে নিচু হয়ে চুমু দেয়। খাটের পায়া ধরে কয়েকজন কিশোরী উবু হয়ে কেঁদে ওঠে ভালবাসায়।
সমীরণ হাঁ কবে দেখে, মন্দা দু’হাতে মালাটা ধরে পরিয়ে দিচ্ছে ফজলুর গলায়।