মালিকের মেয়ে একবার তার হাত ছুঁয়েছিল, সেই স্মৃতিই সব সময়ে সমীরণকে জাগিয়ে রাখে সতর্ক রাখে। আজকাল সে কখনও ঘুমে ঢুলে পড়ে না। টেলিফোনের প্রথম রিংটা একবার টিং করে বাজতে না বাজতেই সে ফোন তুলে নেয়। কতবার ভুলও হয়। মাঝে মাঝে সুখনের চায়ের কাপে চামচে নাড়ার শব্দকে রিং ভেবে টোলফোন তুলে নিয়েছে। আজকাল তার শরীর টেলিফোনে সমর্পিত।
রায়বাবু আর আচার্যিবাবু হয়তো কাল পরশু চলে আসবেন। তখন মন্দা এত ঘন ঘন আসবে না। অফিসে। টেলিফোনে বলবে না, আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করুন। আপনাকে দরকার হবে।
দরকারটা কী তা আজও জানে না সমীরণ। জানবার জন্য ভীষণ আগ্রহে তার বুকের শিরা উপশিরা টান টান হয়ে থাকে। মাথা ছিড়ে পড়ে। কিন্তু মন্দা কখনও স্পষ্ট করে বলেনি।
যেমন আজ বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ বেরোল। যাওয়ার সময় বলে গেল, আমার লাঞ্চ আছে। আপনি কিন্তু থাকবেন। আজ হয়তো আমি সামান্য ড্রাঙ্ক থাকব। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হতে পারে। পারবেন তো?
পারবে না? সে অবাক মানে। পারবে না কেন? মন্দার জন্য সে না পারে কী? মন্দার ভাল পাহারাদার হওয়ার জন্য সে আজকাল আবার ব্যায়াম শুরু করেছে। একবার আসুক না রজত মাস্তান। খোপড়ি খুলে দেবে সমীরণ।
সে ঘাড় কাত করে মাকে বলল, খুব পারব।
তারপর একটা নাগাদ একবার ফোন করল মন্দা, আছেন তো সমীরণবাবু?
আছি।
থাকবেন। আমরা খুব মজা করছি।
খুব খুশি হয় সমীরণ। আনন্দের গলায় বলে, করছেন? করুন।
কেউ আমার খোঁজ করলে বলবেন ব্লু রুম। এই বলে মন্দা ফোন রেখে দিল।
.
সারা সকাল নীচের রাস্তা দিয়ে একটার পর একটা মিছিল যাচ্ছে। শ্লোগানে শ্লোগানে কান ঝালপালা। গত হপ্তাখানেক ধরে একই শ্লোগান, ফজল আলী জিন্দাবাদ। ফজল আলীর মৃত্যু নেই! ধনিকতন্ত্র নিপাত যাক! শ্রমিক নিধন চলবে না! ফজল আলী যুগ যুগ জিয়ো! ফজল আলী অমর রহে।
ফজলুর ডেরা বেশি দূরেও নয়। সেখান থেকে লাউডস্পিকারে বক্তৃতা ভেসে আসে, দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হয়। আগামীকাল প্রাইম মিনিস্টার ফজলুকে দেখতে আসছেন দিল্লি থেকে। দু-চার দিনের মধ্যেই আসবেন রাষ্ট্রপতি স্বয়ং।
প্রতিদিন ফজলুর খবর থাকে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায়। বিকেলের দিকে দু’একটা ছুটকো ছাটকা কাগজ টেলিগ্রামও বের করে।
ফজলু না খেয়ে আছে কত দিন! পারবে তো?
আজকাল আর ফজলুর কাছে হুট করে যাওয়া যায় না। চারদিকে কড়া পুলিসের পাহারা। গিসগিস করছে মানুষ। সেখানে মানুষের দেয়াল এত পুরু যে ব্যায়াম করা শরীর নিয়ে সমীরও তা ভেদ করে বেশি দূর যেতে পারে না। পলাশি গাঁয়ের ফজলু আজ কত বড় হয়ে গেছে।
ফজলুকে নিয়ে এত হইচই আর চেঁচামেচি সমীরণের খারাপ লাগার কথা নয়। বরং অহংকারে বুক বেলুন হয়ে ওঠারই কথা। কিন্তু মুশকিল হল সদা সর্বদা মিছিলের চেঁচামেচি শুনতে শুনতে আজকাল তার কান ভোঁ ভোঁ করে। ভয় হয়, ঠিক মতো টেলিফোনের রিং সে হয়তো শুনতে পাবে না। যখনই মিছিল যায় তখনই সে আতঙ্কিত হয়ে টেলিফোনের কাছে উপুড় হয়ে যন্ত্রটায় কান লাগিয়ে রাখে। রিং শুনতে ভারী অসুবিধে হয় তার। ফজলুটাই বাগড়া দিচ্ছে।
টেলিফোন বাজল কি? বুঝতে পারে না সে। বিশাল মিছিল যাচ্ছে আবার।
সারাদিন আন্দাজে আন্দাজে সে বহুবার টেলিফোন তুলে কানে লাগায় এবং হতাশ হয়। এবারও তুলল। বুকটা লাফিয়ে উঠল।
টেলিফোনে একটা প্রচণ্ড গোলমাল শোনা যাচ্ছে, সেই শব্দ ছিড়ে মন্দার তীব্র গলা শোনা গেল, সমীরণ?
আমি… আমি…!
একটু হেলপ করবেন?
নিশ্চয়ই… যা বলবেন।
গোলমাল ছিড়ে মন্দার কুহুস্বর আসে, ভীষণ বিপদে পড়েছি। কিছুতেই ফজল আলীর কাছে যেতে পারছি না।
স্তম্ভিত সমীরণ বলে, ফজলুর কাছে যাবেন? সে কী?
যেতেই হবে। একটা বিরাট সুন্দর মালা কিনেছি। ফজল আলীর গলায় পরাব। কিন্তু যাব কী করে? মালা দেওয়ার জন্য এক মাইল লম্বা মানুষের লাইন পড়েছে, কিন্তু সে লাইনও ভেঙে যাচ্ছে। পুলিশ লাঠিচার্জ করছে বার বার। ভীষণ ক্যাওস। এদিকে আমার মালাটাও শুকিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। একটু হেল্প করতে পারবেন?
ফজলুকে মালা দেবেন? অবাক হয়ে যেন নিজেকেই নিজে বলে সমীরণ।
মন্দার কুহুস্বর আসে, দিতেই হবে। প্লিজ! তাড়াতাড়ি চলে আসুন। টেলিভিশনের গাড়ি এসে গেছে। এলিট সিনেমার নীচে দাঁড়াচ্ছি।
ফোন রেখে ঝড়ের গতিতে নেমে গেল সমীরণ।
.
ফজলুদের পুরনো ত্রিপলের ছাউনি ভেঙে কখন যেন বিশাল ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। লাল সাদা বাহারি ম্যারাপের মাথায় সব দল তাদের ঝান্ডা লাগিয়ে দিয়ে গেছে।
ম্যারাপের আধ মাইল ব্যাস জুড়ে ভিড় আর ভিড়। মানুষের শরীর একটার সঙ্গে আর একটা সিমেন্টে গাঁথা ইটের মতো লেপটে আছে। হাজার হাজার গাড়ি পার্ক করা চারদিকে। এক মাইল দুরে গাড়ি রেখে হেঁটে আসছে সুন্দর পোশাকের মানুষ আর মেয়েমানুষ। কঠিন দেয়াল। পিলপিল করে আরও মিছিল আসছে আর আসছে।
কিছু চ্যাঙা চ্যাঙা ছেলে ছোকরা চেঁচাচ্ছে, গুরু। গুরু।
মানুষের মুক্তিদাতা ফজল আলী…
জিন্দাবাদ!
মহান সংগ্রামী ফজল আলী…
জিন্দাবাদ!
সর্বহারার শ্রেষ্ঠ বন্ধু ফজল আলী…
জিন্দাবাদ!
স্কুল কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসছে দল বেঁধে। তারা গান গাইছে, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে…