প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি বৌধায়নের যে এ লোকটা সেই নাচার বুড়ি। কিন্তু পায়ের প্রচণ্ড ব্যথায় ‘ওফ’ বলে চেঁচিয়ে বালিশ আঁকড়ে ধরেই সে টের পেল, এই কাজল, পাউডার মাখানো টিপ পরা বুড়িটা স্বয়ং ডাইনি।
এক ঝটকায় পা টেনে নিয়ে সে বাঘা গলায় হুংকার ছাড়ল, গেট্টাউট! গেট্টাউট! ভাগো হিয়াসে! বেরোও!
বুড়ি থতমত খেয়ে বলল, কী হল বাবা, লাগল?
চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে বৌধায়ন, কে তোমাকে এ ঘরে ঢুকতে বলেছে?
বুড়ি ভালমানুষের মতো বলে, চুরি চামারি করতে ঢুকিনি বাবা। তোমার মাগমশাই যে বলল, তেনার পায়ে ব্যথা, টেপো গে যাও। কোনও দোষঘাট হলনি তো বাবা? তোমার মাগমশাইকে ডেকে পুছ করো না।
মাগমশাই! বৌধায়ন কথাটা ধরতে পারছিল না। রাগে ভিতরটা গনগন করছে। তবু গলা এক পর্দা নামিয়ে মুখ ভয়ংকর বিকৃত করে বলে, কে বলেছে বললে?
তোমার মাগমশাই গো। ওই যে সুন্দর মতো মেয়েছেলেটা।
মাগমশাই! বৌধায়ন মাগ মানে জানে, কিন্তু সঙ্গে মশাইটা কেন? তার ঠাকুমা মেয়েছেলে মার্কা পুরুষকে মাগিমশাই বলত, কিন্তু মাগমশাইটা কী?
গলা ফাটিয়ে বৌধায়ন ডাকতে লাগল, বউদি! এই মেজবউদি!
জয়তী দৌড়ে আসে।
কী হয়েছে বুধো?
একে কে ঘরে ঢুকিয়েছে? কোনও চালাকি কোরো না।
বুড়ি বলে ওঠে, এই তো গো! তোমার—
চোপ!-বলে ধমক মারে বৌধায়ন!
জয়তী থমথমে মুখ করে বলে, ছিঃ বুধো। গরিব নাচার বুড়িটাকে কখন থেকে অপমান করছ বললা তো? গরিব বলে কি সম্মান নেই? বেচারাদের কত কষ্টের জীবন!
বৌধায়ন স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, মাগমশাই মানে কী?
আমি কি ডিকশনারি যে সব কথার মানে জানব?
বলবে কি না! ইজ ইট হিন্দি?
না।
তবে?
মাগ মানে বউ। আর মশাইটা বোধহয় সম্মানসূচক শব্দ হিসেবে সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে।
তার মানে তুমি আমার বউ?
ও তাই ভুল করে ভেবেছে।
বৌধায়ন চোখ বন্ধ করে বলে, এটাকে এক্ষুনি বের করে দাও। ইস! পাউডার! কাজল! টিপ। অ্যান্ড শি ইজ নিয়ার অ্যাবাউট এইট্টি!
ছিঃ বুধো! ও যাবে কোথায় এখন? এনেছ যখন থাক।
বৌধায়ন লাফিয়ে উঠে রাগে চেঁচাতে থাকে, বের করে দেবে কি না? না কি নরেনকে ডাকব? আই মে ইভন কল দি পলিস।
দিচ্ছি বাবা, দিচ্ছি। তুমি শুয়ে থাকো তো! খুব লেগেছে নাকি?
ব্যথায় নীলবর্ণ হয়ে বৌধায়ন ডান পা-টা বুকে তুলে নেয়। তারপর কাতরাতে থাকে।
.
আগে রুবি আয়রন ফাউন্ড্রির কর্মীদের অনশনের খবর বেরোত ছোট্ট করে। কিন্তু আজকাল প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে খবর ছাপা হচ্ছে। চারদিকে চাপা গুঞ্জনে ফজল আলীর নাম শোনা যাচ্ছে।
.
ব্লু রুমে পার্টি দিল রজত। আর বেশিদিন সে নেই। তার জাহাজ বম্বে থেকে শিগগিরই ছাড়বে!
বৌধায়ন পার্টিতে হাজির হতে না হতেই চারপাশ থেকে সবাই চেঁচিয়ে ওঠে, হিয়ার কামস দা গ্রেটেস্ট সেভিয়ার অফ হিউম্যানিটি। হিয়ার কামস বৌধায়ন দা বুদ্ধ! হিয়ার কামস দা লিবারেটার।
বৌধায়ন মুখ বিকৃত করে। এখনও পায়ের হাড়ে-মজ্জায় সেই ব্যথা। রক্তের প্রতিটি কণিকায় রাগের আগুন। জয়তীই খবরটা রটিয়েছে। সে মন্দাকে খলিলের মা’র খবরটা দেয়। তারপর সেটা জলের মতো ছড়িয়ে গেছে। এখন বৌধায়নের ড়ুবজল।
রজত তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, যে যাই বলুক আই ফিল প্রাউড অফ ইউ। এবার দেশে এসে দুটো ইভেন্ট আমাকে দারুণ ইমপ্রেস করল। একটা তোর ব্যাপারটা, অ্যাবাউট দ্যাট ওল্ড লেডি। যদিও শেষটায় অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে তোর দোষ নেই। আর দ্বিতীয়টা হল ফজল আলীর ফাস্টিং। দি নিউজ ইজ নাউ অল ওভার দা ওয়ার্ল্ড। আমি পরশুদিন গিয়ে মালা দিয়ে এসেছি। ফজল ইজ স্টিল হ্যাংগিং অন ইট। আই অ্যাম প্রাউড অফ হিম।
হাউ টাইগরিশ!–মন্দা বলে, দিস ইজ দা জাস্ট টাইম আই শুড রিয়েলি বি ইন লাভ উইথ সামওয়ান। অ্যান্ড হি ইজ দি গ্রেট ফজল আলী।
সুব্রত মাথা নিচু করে বসেছিল এতক্ষণ। মুখ তুলে বলল, আমেরিকা থেকে টি ভি টিম এসেছে ফজলের ছবি নিতে। পেঙ্গুইন বই বের করছে, দি হাঙ্গার আর্টিস্ট। ওই নামে কাফকার একটা গল্পও আমি পড়েছি।
এইরকম কথাবার্তা চলতে থাকে। খুব বেঁচে যায় বৌধায়ন। ফজল আলীর অনশন না ঘটলে এতক্ষণ খলিলের মা’র প্রসঙ্গ চলত।
প্রথম রাউন্ড হুইস্কিটা সকলেই গ্লাস তুলে ফজল আলীর নামে উৎসর্গ করে। কিছুক্ষণ মদ্যপানের পরই সুব্রতর চোখ ছলছল করতে থাকে, ঠোঁট কাপে এবং হঠাৎ সে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে, ওঃ ফজল আলী ইজ সো গ্রেট!
আরও দু-একজনও সেই কথা বলে। এবং কাদে। কান্নাটা পুরো রু রুমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চারদিকে লোকেরা গ্লাস তুলে ফজল আলীর স্বাস্থ্য পান করে। ফজল আলীর নামে চোখের জল ফেলে।
বৌধায়ন মদ খায় না। সারাক্ষণ সে মুখ বিকৃত করে বসে রইল আর ভাবতে লাগল, সারা দেশ যখন অভাব আর দারিদ্রে ড়ুবে যাচ্ছে, তখন হাজার হাজার টাকার মদ ..
কী ভাবছ?—মন্দা জিজ্ঞেস করে আস্তে।
বৌধায়ন তার হাতের শেরির গ্লাসটা কেড়ে নিয়ে ছাইদানে উপুড় করে দিয়ে বলে, লজ্জা করে না মন্দা?
মন্দা হাসল। বলল, তোমার মন এখন দয়ার দুধে ভরা।
বৌধায়ন ঘৃণাভরে বলল, আই হেট অল দিজ থিংস। আমি তোমাকেও ঘেন্না করছি মন্দা।
মন্দা অবাক হয়ে বলে, বটে! ঠিক আছে, কী করতে হবে বলো!
জবাব দেয় না বৌধায়ন। গুম হয়ে বসে থাকে। কোথাকার কে এক ফজল আলী, সামান্য শ্রমিক, গোটা দেশের মনোেযোগ কেড়ে নিল। সে পারল না।
১১. মালিকের মেয়ে
১১.