একবার ওয়াক তুলল বৌধায়ন। তাড়াতাড়ি স্টার্ট দিল গাড়িতে। সে বড় একটা সিগারেট খায় না। এখন মনে হল, একটা সিগারেট ধরালে ভাল হত। বুড়িটা গাড়ির মেঝেতে বসেছে উবু হয়ে। সাহস করে তাকে আর সিটে বসতে বলল না সে। বুড়ি ভয়ে আর ভরসায় গদগদ হয়ে বলছে, ও বাবা! কোথায় নেচ্ছ মোরে? মারধর করবে না তো? হেই বাবা! দুটো খেতে দেবে তো?
ফুৎ করে কাপড়ে নাক ঝাড়ে বুড়ি। তারপর থুথু ফেলে।
বৌধায়ন সঁতে দাঁত চেপে গাড়ি চালাতে থাকে। তাকে এই ঘেন্না জয় করতেই হবে। তাকে হতেই হবে মানুষের মুক্তিদাতা।
তাদের গ্যারেজঘর আর জলের পাম্পঘরের মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা। বুড়িটাকে সেইখানে এনে তুলল বৌধায়ন। তারপর সিঁড়ি ভেঙে ওপরে গিয়ে খুব গম্ভীর মুখে রান্নার লোককে বলল, ঠাকুর একথালা ভাত বাড়ো তো। বাইরের লোক আছে।
কয়েক মুহূর্ত সারা বাড়িতে খবর রটে গেল। আর বেঁধে গেল বিরাট হইচই। মা, বাবা, দাদা, বোন সবাই চেঁচামেচি করতে থাকে।
এটা কি লঙ্গরখানা নাকি?…দুটো ভাত দিবি তো দে, তা বলে রাখবি নাকি ওকে? কোথাকার পাগল রে?…বুধোর মাথাটা একদম গেছে মা, ওকে শিগগির বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দাও।…সেজদার যা কাণ্ড, আজ আমি দুপুরে খেতেই পারব না।
জয়তী কিছুই বলছিল না, শুধু মস্ত চোখে চেয়ে দেখছিল আর মৃদু মৃদু হাসছিল।
গা জ্বলে গেল বৌধায়নের। কিন্তু সে তো জানতই যে এসব কাজে বাধা আসে, প্রতিরোধ আসে। ভেঙে পড়লে চলে না। সে প্রাণপণে শান্ত রইল। মাকে বলল, তা হলে আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। আমি চলে যাই…
এ কথার ওপর কথা চলে না। বাড়ির গনগনে মেজাজ মিইয়ে গেল।
বুড়িটা রয়ে গেল।
পরদিন সকালবেলাতেই নরেনের চেঁচানি শোনা গেল, হেগেছে! হেগেছে! ওই দেখো আবার পোঁটলায় লুকোচ্ছে।
সবাই গিয়ে দেখে বুড়ি তার মল একটা পুরনো খবরের কাগজে জড়িয়ে আঁচল চাপা দিয়ে বসে আছে। জায়গাটায় একটা তরল কিছু মুছে নেওয়ার চিহ্ন আর দুর্গন্ধ।
মা বৌধায়নের কাছে এসে বলে, এবার কী করবি?
খুব স্নান শুকনো মুখে বৌধায়ন বলে, আমি? আচ্ছা, না হয় আমিই পরিষ্কার করব। ওর দোষ কী? ওকে তো কেউ পায়খানাটা দেখিয়ে দেয়নি।
খুবই সাহসের কথা। বীরোচিত। কিন্তু বলেই সে পেটের ভিতর গোঁতলানো টের পায়।
মা ঠোঁট উলটে বলে, দেখিয়ে দিলেই কী? ওরা যেখানে খায় সেখানেই হাগে বাবা। স্বভাব যাবে কোথায়?
নরেন মেথর খুঁজতে বেরোল। বৌধায়ন বসে ভাবতে লাগল।
পরদিনই আবার গণ্ডগোল। ধীরেনকাকুর বাড়ির সব বেড়াতে এসেছিল সন্ধেবেলায়। তারা যখন চলে যাচ্ছে তখন নীচের প্যাসেজে বুড়ি তাদের পথ আটকে ভিক্ষে চেয়েছে, ও বাবা! বাবাগো! কিছু দেবে বুড়ো নাচারকে?
মা বলল, কী কাণ্ড!
বাবা চেঁচাতে থাকেন, বের করে দাও! বের করে দাও।
পরদিন দুপুরেই খলিলের মা নির্জন বাড়িটা একটু ঘুরে-টুরে দেখবে বলে ওপরতলায় চলে এল। এ ঘর সে ঘর বেড়িয়ে দেখল। খাওয়ার ঘরে গিয়ে ফ্রিজের দরজা খুলে ফের বন্ধ করে দিল ভয়ে। বারান্দায় অযত্নে ফেলে রাখা একজোড়া রবারের চটি দেখে বড় পছন্দ হয়ে গেল তার। এরা কত বড় মানুষ, চটিজোড়া বোধহয় ফেলে দিয়েছে ভেবে পায়ে গলিয়ে ফটাফট হেঁটে নেমে গেল নীচের তলায়।
চটি নিয়ে হইচই ঝিমিয়ে পড়ার আগেই খলিলের মা এক সন্ধেবেলা বাড়ির কেউ খাওয়ার আগেই রান্নাঘরে হানা দিয়ে ঠাকুরকে বলল, গরম গরম রুটি সেঁকার কী বাস বেরিয়েছে গো বাবা। দাও দু’খানা খাই।
মা ধেয়ে এল রাতে বৌধায়নের ঘরে, তুই ভেবেছিসটা কী?
বৌধায়ন সব শোনে। গম্ভীর মুখে বলে, এতে অস্বাভাবিক কী আছে? এরকমই হওয়ার কথা।
এক দুপুরে খলিলের মা চুল শুকোতে দোতলার ব্যালকনিতে গেছে। জয়তী হাসিমুখে বেরিয়ে এসে বলল, কী গো? তোমার কি একটা কাপড় চাই?
একগাল হেসে খলিলের মা বলে, দেবে?
জয়তী একটু পুরনো শাড়ি এনে দিয়ে বলে, একটু পাউডার-টাউডার মাখবে নাকি?
বস্তুটা কী তা ভাল বুঝতে না পেরে খলিলেব মা বলে, একটু তেল থাকে তো দাও।
জয়তী দিল। এমনকী বাথরুমে নিয়ে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত মুখ ধুতেও শেখাল। একটু ঘেন্না হল বটে তবু নিজের হাতে বুড়িকে আচ্ছা করে পাউডার মাখাল, কাজল টেনে দিল চোখে, টিপ পরাল। বুড়ি হেসে কুটিপাটি। বুড়িকে বশটশ করে বলল, তা যে-বাবু তোমাকে আদর করে নিয়ে এল তার একটু সেবা করো না কেন? যাও না। কোণের ঘরে শুয়ে আছে, গিয়ে একটু পা টিপে দিয়ে এসো। ডান পায়ের গোড়ালিতে বাতের ব্যথা, টিপলে আরাম পায়।
বুড়ি খুব রাজি! নতুন শাড়ি পেয়েছে, তেল পেয়েছে, সাবান মেখেছে, সেজেছে। হেসে বলে, সে হীরের টুকরো ছেলে। তুমি কি তার মা নাকি?
জয়তী মিষ্টি করে হাসল শুধু। মাগ মানে সে জানে। কিন্তু ভাঙল না।
.
বৌধায়ন অঘোর ঘুমে। সারা গায়ে টোপা টোপা ঘাম। ডান পা সম্পর্কে সে ঘুমের মধ্যেও সচেতন থাকে। পা খানা বিশাল একটা পাশবালিশের ওপর সাবধানে রাখা।
হঠাৎ সেই অতি অনুভূতিশীল ডান পায়ের গোড়ালির গোছের ওপর আচমকা প্রবল আক্রমণে সে আঁতকে ককিয়ে জেগে উঠল।
আর জেগে উঠে সে নির্জন দুপুরে চোখের সামনে জলজ্যান্ত ভূত দেখে প্রাণভয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কে? কে? কে?
বুড়ি বড় আদর দেখিয়ে হেসে উঠে পা দাবাতে দাবাতেই বলল, এখন একটু আরাম হচ্ছে বাবা?