আয়।
নিত্যপদ এসে বসে মুখোমুখি। হাতটা প্যান্টের গায়ে মুছে নিয়ে একটা গরাস রসগোল্লার মতো পাকিয়ে মুখে ফেলে বলে, আজ রান্না হয়নি।
কেন?
দাদার বউটা কেটে পড়ল যে!
কখন?
সকালবেলায়। দাদা শেষরাতে খুব ঠেঙিয়েছিল। দাদা বলেছে, আবার বিয়ে করবে।
এটা কোন পক্ষ ছিল রে? চারটে হল না?
না। এ মাগি ছিল তিন নম্বর।
হরিদেব হেসে বলে, খুব চোর হয়েছিস। সমীবাবুর মুড়ির ফেরত পয়সা দিসনি! দেবেখন সমীবাবু ধরতে পারলে।
তুমি যে কেরোসিনের পয়সা দাওনি। তার বেলা?
আমারটা নেবে না। তোকে পেলে বলেছে হাড় ভাঙবে।
ইঃ, এমন দৌড় মারব।
হরিপদ নিত্যপদর দৌড়ের কথা শুনে খুব হাসে। তার হাতের ফঁাকে আঙুল ঢুকিয়ে নিত্যপদ গরাস চুরি করছে। টের পেয়েও কিছু বলে না সে। খাক। কারটা কে যে খায়!
এঁটো হাত চেটে হরিদেব বলে, ও বাড়ি থেকে একটা কঁাথা এনে দিবি? এবারে বড় শীত পড়ে গেল।
শীত! যা ভ্যাপসা গরম পড়েছে। শীত কোথায়?
তবে আমার শীত করছে কেন?
তুমি তো এবার মরবে। মরার সময় লোকের গা ঠান্ডা হয়ে আসে কিনা।
হরিদেব খুব হাসে। চোখে জল এসে যায় হাসতে হাসতে। বলে, তোকে বলেছে!
মা বলেছে, তোর বাপের যা হাবভাব দেখছি, আর বেশিদিন নয়। এবার টেঁসে যাবে।
বউয়ের কথায় ভারী ভক্তির সঙ্গে বড় বড় চোখ করে হরিদেব বলে, বলেছে তোর মা?
হুঁ।
তৰে তাই হবে। কথাটা এনে দিবি?
দাদার বউটা বিছানাপত্র নিয়ে যায়নি কিছু। একটা তুলোর কম্বল আছে দেখেছি বিছানায়। চুরি করে এনে দেবোখন।
চুরির কথায় ভারী আমোদ হয় হরিদেবের। খুব হাসে। তার আঙুলের ফঁক-ফোকর দিয়ে কচি কচি আঙুল ঢুকিয়ে নিত্যপদ গরাসের ভাত চুরি করে নিচ্ছে! সব নিয়ে নিল। তারপর হরিদেবের হাতটাকে পাত থেকে তুলে যত্ন করে মাটিতে রেখে থালাটা চেঁছে চেটেপুটে খেতে লাগল। ভারী আনন্দের চোখে চেয়ে থাকে হরিদেব। তার বউ বলেছে যে, সে এবার মরবে। বড় বাড়িতে কাজ করে তার বউ, মাস গেলে ষাট-সত্তর টাকা পায়, ঘোয়া শাড়ি ব্লাউজ পরে, বাবুদের বাড়ির মেয়ের মতো থাকে। তার কথার দামই আলাদা। সে তো আর মিথ্যে বলবে না। বউয়ের কথা ভেবে ভারী অহংকার হয় তার।
হরিদেব ভারী হাসতে হাসতে বলে, আমি ম’লে ছেরাদ্দ করবি?
নিত্যপদ মুখ ঊর্ধ্বপানে তুলে হাতের তেলো চাটতে চাটতে বলে, হ্যাঁ-আঁ। নানকুদার বাপ মরলে নানকুদা কালীঘাটে গিয়ে যেমন মন্ত্র পড়ল, মাথা কামাল, ঠিক সেরকম হবে বাবা?
সত্যি করবি?–ভারী অবাক হয়ে বলে হরিদেব।
দাদা ঠিক করবে, দেখো। করতে না চাইলে মা বকে বকে করাবে। দেখো।
হরিদেব ভারী অবাক হয়। তার জন্য হরিপদ আর নিত্যপদ কালীঘাট যাবে, মন্ত্র পড়বে, মাথা কামাবে, অ্যাঁ? তার জন্য এতটা করবে লোকে? এত কিছু করবে? ঠিক যেন বিশ্বাস হতে চায় না। তবে ভাবলে ভারী অহংকার হয়।
.
১০.
শাবানা আজমির পায়ের তলায় বসে আছে খলিলের মা।
এত সুন্দর শাবানা আজমির নাচের ভঙ্গিটি যে পোস্টারের ছবিতেও যেন নূপুরের রুনুঝুনু শোনা যায়। ল্যাম্পপোস্টের গায়ে পোস্টার লাগানোর চৌকো বাক্সটা ঢিলে হয়ে নীচে নেমে পড়েছে। এখন শাবানা আজমি হাতের নাগালে। এত কাছে যে তার গায়ের সুগন্ধ পাওয়া যায় বুঝি।
পুরনো কাগজওয়ালাটা সৌন্দর্যের ভিখারি নয়। সে তাই মন দিয়ে লম্বা নোংরা নখ দিয়ে পোস্টারটা খুঁটে খুঁটে তুলে নিতে থাকে।
খলিলের মা প্রাণপণে ডাকছে, ও বাবারা! ও বাবারা আমার! কিছু দিয়ে যাও!
একসময়ে তার নাম ছিল জোহরা। সে নাম ভাল করে মনেও পড়ে না। খলিলও মরে গেছে। কবে! ধোঁয়ার মতো মনে পড়ে। তবে তার জোহরা নামটা আর নেই। এখন শুধু খলিলের মা। সঙ্গী সাথীরা তাই ডাকে।
খলিলের মা কাগজওয়ালার দিকে বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলে, গায়ে পা লাগছে, দেখছ না নাকি? সরে দাঁড়াও।
কাগজওয়ালাটার আঙুলে উঠে আসছে শাবানা আজমি। অমন সুন্দর নাচের বিভঙ্গ কোমর থেকে বুক পর্যন্ত ফেড়ে গেল। শুধু শাবানার করুণ মুখশ্রী চেয়ে দেখে খলিলের মাকে।
আর একজনও দেখছিল খুনখুনে বুড়িটাকে। আহা রে! মরার আগে কয়েকটা দিন মাত্র বেঁচে আছে বুড়িটা। জীবনে কখনও কি পেট ভরে খেয়েছে? ভালবাসা পেয়েছে? কোনও সুখাদ্যের স্বাদ কি ওর মনে পড়ে?
খলিলের মা বিলাপ থামিয়ে নতুন লোকটার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বলে, কী বাবা? কোথায় নে যাবে বাবা আমাকে?
লোকটা দু’ হাত বাড়িয়ে বলে, চলো বুড়ি মা, অনেক খাওয়াব তোমাকে। যাবে?
নে যাবে? ও বাবা, বলে কী! নে যাবে! তা ক্ষেতি নেই। ক্ষেতি কী? তাকে দিয়ে আর কোনও কাজ হবে? বয়সকালের মেয়েমানুষ নয় ইজ্জত কেড়ে নেবে, পয়সা কড়ি নেই যে কাড়বে। তবে ক্ষেতি কী?
কোথা যাব বাবা?
আমার বাড়ি।
একগাল হাসে খলিলের মা। বলে কী? পিরের থানে শিন্নি গো! ই কী? এ বাবার যে মটোর আছে গো! ই বাবা! সব সত্যি তো? খোয়াব নয় তো! নেবে আমাকে সত্যি?
তা নেয়।
শাবানা আজমির সুন্দর করুণাঘন মুখশ্রী লোপাট হয়ে যায় নোংরা নখের খাবলায়। জায়গাটা শ্রীহীন হয়ে গেল অনেকটা। আবার নোংরা খুনখুনে বুড়িটা চলে যাওয়ায় জায়গাটার কুশ্রীতাও ঘুচে গেল কিছু! একটা সাম্য এল, সমতা দেখা দিল আবহাওয়ায়।
খলিলের মা’র গায়ের ট্যানাটা হাজারও বার জলে ভিজে গায়ে গায়ে শুকিয়েছে। পরতে পরতে গায়ের ঘাম আর ময়লা সেঁধিয়ে হাকুচ হয়ে বসে গেছে। চিমসে গন্ধে টেকা দায়। হাতের পায়ের গাঁটে গাঁটে ময়লা জমে আছে ঘায়ের মামড়ির মতো। হাতের তেলোয় থিকথিকে নোংরা বসে চামড়ার মতো হয়ে গেছে।