প্রথমে কেউ সাড়া দিল না। তারপর আস্তে একটা ফুলের তোড়া পড়ল। খসে গেল একটা দুটো মালা। আর সেই সাদা তাজা রজনীগন্ধার ভিতর থেকে ফজলুর মড়ার মতো বাসি মুখ বেরিয়ে আসে অল্প একটু। ভুতুড়ে নাকি স্বরে, ক্ষীণ গলায় সে বলে, কে? মলয়বাবু?
না রে। আমি সমীদা।
বোসো।
সমীরণ বসে রুমালে মুখের ঘাম আর চোখের জল মোছে। রবারের বলের মতো কান্নাটা আটকে ছিল গলায়, সেটাকে গিলে ফেলল সে। স্পষ্টতই সেটা তার পেটে চলে গেল।
ফজলুর মাথার রুখু চুলে হাত বুলিয়ে সমীরণ বলল, পারবি না ফজলু। আজ একজন মারা গেছে।
ফজলু হাসল। ওর মুখের চামড়া শুকিয়ে খুলির সঙ্গে এমনভাবে লেপটে গেছে যে কঙ্কালের মুখ ফুটে উঠছে স্পষ্ট। ফজলু বলল, কায়দাটা না জানলে তো মরবেই। ইচ্ছে চাই বুঝলে। খুব জোরালো ইচ্ছে চাই।
কীরকম?
আলোতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভাবতে হয়, এই যে আমার হাত আলো থেকে প্রোটিন নিচ্ছে। আমার চামড়া বাতাস থেকে ক্যালসিয়াম নিচ্ছে। মাটিতে পা রেখে ইচ্ছে করতে হয়, আমার পা দুটো মাটি থেকে রস শুষে নিক। ওরকম মনে করলে, খুব জোর করে ইচ্ছযুক্ত হলে তবে হয়। আমার হচ্ছে।
পারবি ফজলু?
পারব কী গো! পারছি। প্রায় পেরেই গেছি। প্রথমটায় একটু আস্তে আস্তে হয়। অনভ্যাস তো। কদিন পর দেখবে, না খেয়েই ক্রমে ক্রমে শরীরে জুত পাচ্ছি। তখন উঠব, হাঁটব গান গাইব। কিছু শক্ত নয়। ভেবো না।
বিড়ি খাবি ফজলু?
আছে? দাও তবে।
বিড়ি কিনেই এনেছিল সমীরণ। ফজলুর ঠোঁটে লাগিয়ে ধরিয়ে দিল যত্নে।
ফজলু বিড়িটা টানতে পারছিল না। চোয়ালের জোর নেই, ঠোঁট ঝুলে পড়েছে। তবু দু’-তিনটে টান দিয়ে বলল, কত ভিটামিন চারদিকে! শ্বাস দিয়ে ঢুকে পড়ছে ভিতরে। আর ক’দিন পরেই ইস্কুল খুলব, শেখাব। একটা বই লিখব, কী করিয়া না খাইয়া বাঁচিয়া থাকিতে হয়। ঘরে ঘরে গীতা, বাইবেল, কোরানের মতো লোকে সে বই পড়বে। দেখো।
পারবি ফজলু?
পারব। পেরেই গেছি প্রায়। প্রথমটায় যা একটু কষ্ট। বড় একঘেয়ে লাগে। আমি একটু চোখ বঁজে থাকি সমীদা?
থাক। বলে সমীরণ ওঠে।
আবার রজনীগন্ধায় ঢেকে যায় ফজলু। বাইরে ভিড় বাড়ছে। বিশাল দুটো মিছিল এসে জড়ো হল এইমাত্র। রাস্তা জ্যাম। গাড়িঘোড়া বন্ধ।
.
সমীরণের যা অবস্থা তাতে রোজ আধ লিটার করে দুধ খাওয়া তার পোষায় না। তবে কিনা তার চাকরিটা স্বাস্থ্যের জন্যই। সে হল গিয়ে বডিগার্ড, এ ডি কং, সিকিউরিটি অফিসার। তাই পাঁচ কথা ভেবে সে ‘জয় কালী’ বলে আধ লিটার দুধের কার্ড করেছিল। সেই মহার্ঘ দুধের এক বোতল কাল নষ্ট হয়েছে, ছানাটা মেরে দিয়েছে লোভী বুড়োটা আর তাদের ছেলেটা। তার ওপর আজকের দুধটা আনাই হল না, মালিকের মেয়ের খেয়ালে আটকা রইল অফিসে। পয়সাটা পয়মাল। মনটা তাই খচ খচ করে সমীরণের। আবার মন্দার কথা ভাবতে ভাবতে বুকটা বেলুন হয়ে যায়। তখন আর দুধের কথা মনে থাকে না। তখন আনন্দটাই যেন দুধ হয়ে গলা দিয়ে পেটের মধ্যে বগবগ করে চলে যেতে থাকে।
এই ভ্যাপসা গরমেও বুড়োটা উঠোনে বসে রোদ পোয়াচ্ছে আর পায়ের কড়ার চামড়া খুঁটছে। এক মনে।
সমীরণ ধমকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার ছেলে মুড়ির পয়সাটা ফেরত দিল না যে বড়?
বুড়ো সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে বলে, দেয়নি? মহাচোর হয়েছে মশাই। নষ্ট দুধের ছানাগুলো কাল সব মেরে দিল।
সে তোমারও আশকারা আছে। ওকে বোললা, পয়সা না দিলে ছাড়ব না কিন্তু। আর কেরোসিনের ফেরত পয়সাটা?
সবিস্ময়ে বুড়ো বলে, দিইনি? বড় ভুলে যাই দাদাবাবু। কিছু মনে রাখতে পারি না। আমার বউ এসেছিল কিনা! ছেলের বিয়ে গেল।
সমীরণ গনগন করতে করতে গিয়ে ঘরের তালা খোলে। কিন্তু আজ তার মনে তেমন রাগ ওঠে না। মনটা দুধে ধোয়া। বুকটা বেলুনের মতো ফুলছে। আজ সবাইকেই তার বড় মায়া হচ্ছে। দয়া করতে ইচ্ছে করছে।
.
কোনও ভাল কাজ করেছে বলে তো হরিদেবের মনে পড়ে না।
তবু কী কারণে কে জানে, সমীবাবু দুপুরবেলায় ডেকে খানিকটা পাতকুড়োনো ভাত দিল কলাইয়ের থালায়। বলল, খেয়ে বাসনগুলো মেজে দিয়ো।
আজ্ঞে। ভারী খুশি হয় হরিদেব। খিদেটা লেগেছিল বটে। কিন্তু এমন ভুল যে সেটার কথাও খেয়াল রাখতে পারে না। আজ সকালেই কি, না কি কাল বেহানে নন্দীবাড়ির রেশন তুলে দিয়ে পাঁচখানা গরম রুটি আর পটলপোস্ত খেয়েছিল?
খুব খিদে লাগলে যখন অসহ্য হয়ে পড়ে তখন সে গিয়ে হরিপদর সংসারে হামলা করে। ছেলের বউ কেমন তা দেখেওনি ভাল করে, তবে কিনা বউটা দেয়। ঝাটালাথি মারে না। কিন্তু কাল হরিদেবের বউ নিজে এসে সে বাড়িতে যাওয়া বারণ করে দিয়ে গেছে। বড় কষ্ট যাবে কদিন। সমীবাবুর পাত কুড়োনো ভাত ক’টা পেয়ে আজ বড় ভাল হল।
ছায়ায় গেলে শীত করে। এবার জাড়টা কি তাড়াতাড়ি পড়ল? এটা কোন মাস তা মনে পড়ে না। রোদে বসে কোলের কাছে থালা নিয়ে খুব যত্ন করে ভাত ক’টা মাখতে থাকে হরিদেব। মাখতেই থাকে। অনেকক্ষণ ধরে। মুঠোভর ভাত খেলেই ফুরিয়ে যাবে। চারটে কাক চারদিকে তিনধা নাচন নাচছে। কক’ কা” শব্দ করে কাছে নেচে নেচে আসে, ভয় খেয়ে আবার চার পা পিছিয়ে যায়। গা-শোকা বেড়াল আছে একটা, গন্ধে গন্ধে সেটা এসে উরুতে ঘষটায়।
উঠোনে বসে হরিদেব প্রথম গরাসটা মুখে দিতে না দিতেই কোখেকে নিত্যপদ ‘বাবা’ বলে ডাক দেয়। পরমুহূর্তেই অবাক গলায় বলে, খাচ্ছ?