বৌধায়ন একটু হেসে বলে, দম নাও মন্দা। দম নিতে একদম ভুলে যাচ্ছ।
যাঃ ফাজিল! খুব বেশি বকছি নাকি? কিন্তু ভেবো না এটা কালকের এফেক্ট। কাল বেশি খাইনি। আমি আর লোপা প্রথম একটু একটু জিন আর লাইম খাচ্ছিলাম, পরে রজত জোর করে একটু হুইস্কি খাইয়েছে। বেশি নয়। বেশি খেলে আমার তো মাথা ধরে।
বৌধায়ন মন্দার পিছু পিছু ভিতরের চেম্বারে ঢোকে। মন্দা এয়ারকন্ডিশনার চালু করে। কলিং বেল টিপে বলে, চা খাবে তো?
বৌধায়ন মন্দার দিকে চেয়ে ছিল। আজকাল মেয়েদের দিকে তাকালেই তার দৃষ্টি এক্সরের মতো হয়ে যায়। স্তন, পেট, নিতম্ব সব অনুভব করে সে। আব আর এইটে সে একদম সইতে পারে না। ক্যাতক্যাতে কিছু মাংস আর মাংস। কিছু স্বেদ, শ্লেষ্ম, খাসবায়ু। অথচ মেয়েরা নিজেদের মাংস ভাবতে কত পছন্দ করে আজকাল। মন্দার দিকে চেয়ে সেই ব্যাপারটাই টের পায় বৌধায়ন। সে জানে, সুন্দর এই মন্দাকে কাল মাথামোটা রজতটা ঘেঁটেছে। ইচ্ছে মতো ঘেঁটেছে মাংসের ভূপ। আজকাল পুরুষেরা মেয়েদের মদের মতো খায়, মাংসের মতো চিবোয়, পোশাকের মতো পরে। মেয়েরাও উপভোগ্য খাদ্য পানীয় পরিধেয়র মতো সাজিয়ে দেয় নিজেদের।
বড় একটা শ্বাস ফেলে বৌধায়ন বলে, ওই ভদ্রলোককে আজ বরং ছেড়ে দাও। ছুটি দিয়ে দাও।
জিভ কেটে মন্দা বলে, ঠিক। ইস, কী বিশ্রী কাণ্ড বলো তো! আসলে লোকটা ভীষণ রিলায়েবল। খুব সাহসীও। ওয়াচ ডগের মতো।
দরজা খুলে সুখন উকি দেয়। মন্দা বলে, চা—
তারপর বৌধায়নের দিকে চেয়ে বলে, ঠিক বলেছ। ওকে বরং ছেড়ে দিয়ে আসি। এক মিনিট।
.
০৯.
মন্দা দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই সমীরণ দাঁড়াতে চেষ্টা করে।
মন্দা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তার সামনে ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায়। কিছু বলে না প্রথমে। খুব অবাক ও সুন্দর চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে। মুখে টেপা একটু হাসি।
সমীরণ গোপনে একবার চোখ কচলে নেয়। ভুল দেখছে না তো?
অস্ফুট আবেগের স্বরে মন্দা বলে, ইউ আর সো কারেজিয়াস!
সমীরণ ভীষণ আনন্দে লাল হতে থাকে।
মন্দা তেমনি মুগ্ধ চোখে চেয়েই ধীর স্বরে বলে, আপনার মতো একজন লোক যদি সব সময়ে আমার সঙ্গে থাকে তো আমার আর কোনও ভয় থাকে না। আই নিড ইউ, আই নিড ইউ ভেরি মাচ।
বড় আফসোস হয় সমীরণের, এসব কথা রায়বাবু শুনছেন না। শুনলে ভাল হত।
মন্দা এগিয়ে এসে দুটো অসম্ভব নরম হাতে তার দু’হাত তুলে নিয়ে বলে, প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করুন। ভীষণ অন্যায় করেছি। ইচ্ছে করলে শাস্তিও দিতে পারেন। যা খুশি।
ভীষণ ব্যাকুল হয়ে ফাটা ঠোঁটে রক্ত ঝরিয়ে সমীরণ বলে ওঠে, না, না।
প্লিজ! রাগ করবেন না। আমি কাল থেকে আপনার ফ্যান হয়ে গেছি। দ্যাট ওয়াজ এ গ্রেট পারফরম্যানস। তাছাড়া আমার কথা ভেবে সারা রাত আপনি অফিসে কাটিয়েছেন! কী অদ্ভুত মানুষ আপনি বলুন তো?
সমীরণ শুধু বলতে পারল, না, না।
মন্দার চোখে কি একটু জলের চিকমিকি? কে জানে? কিন্তু ওর গা থেকে সেই অসম্ভব সুন্দর গন্ধটা কেঁপে এসে দম বন্ধ করে দিচ্ছে সমীরণের। আনন্দে আবেগে সে বধির হয়ে যাচ্ছে, অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে।
সমীরণের মুখে নিজের সুগন্ধী, পরিষ্কার শ্বাস ফেলে গভীর স্বরে মন্দা বলে, আজ আপনি বাড়ি চলে যান।
এটার জবাবেও সমীরণ অভ্যাসবশে না, না করে উঠতে মন্দা হঠাৎ তার হাত দু’খানা ছুঁয়ে বলল, প্লিজ!
একটা আনন্দের গ্যাস-বেলুনের সুতো ধরে ঝুলতে ঝুলতে সমীরণ অফিস থেকে বেরোল। তার পা মাটি ছুঁল না, সিড়ি ভাঙল না।
.
বাইরে বিরাট পোস্টারে লেখা, আজ অনশনের এগারো দিন।
আজ ফজলুদের ত্রিপলের বাইরে খুব ভিড়। কাল বিকেলে শ্রমমন্ত্রী এসেছিলেন। তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আজ মুখ্যমন্ত্রী আসবেন। কাগজে কাগজে আজ ফজলুদের ছবি ছাপা হয়েছে। বড় করে খবর বেরিয়েছে। লিখেছে, শ্রমমন্ত্রীর অনুরোধে অধিকাংশ অনশনব্রতী তাঁদের অনশন ভঙ্গ করলেও ফজল আলী, রাজু মিস্ত্রি এবং খগেন রায় রুবি আয়রন ফাউন্ড্রির ক্লোজার, ছাটাই ও হস্তান্তরের বিরুদ্ধে অন্তিম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
খবরের কাগজে কাল রাতের খবর ছেপেছে। আজ সকালে আরও এগিয়ে গেছে ঘটনা। সকালবেলায় মারা গেছে খগেন রায়। রাজু মিস্ত্রির পেটের আলসার ফেটে নাকমুখ দিয়ে রক্ত ছুটছিল বলে তাকে আজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বাকি আছে কেবল ফজল আলী। অর্থাৎ ফজলু।
বাইরে বিশাল জমায়েত থেকে ধ্বনি উঠছিল, সংগ্রামী ফজল আলী জিন্দাবাদ। বিপ্লবী রাজু মিস্ত্রি জিন্দাবাদ। শহীদ খগেন রায় যুগ যুগ জিও।
চোখে জল এসে গেল সমীরণের। আবেগে কেঁাত দিয়ে একটা কান্না গলায় উঠে আসে। ফজলুর কত নাম হয়েছে।
ঢুকবার মুখে একজন তোক পথ আটকে বলে, ভিতরে যাওয়া বারণ আছে দাদা।
সমীরণ জলভরা চোখে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলে, ও আমার গায়ের ছেলে। কত নামডাক হয়েছে ফজলুর। একটু দেখে যাব।
অনিচ্ছার সঙ্গে লোকটা সরে পথ দেয়।
ভিতরে ফজলুকে প্রথমটায় দেখতেই পাওয়া গেল না। রাশি রাশি মালার তূপ আর ফুলের তোড়ার মধ্যে কোথায় হারিয়ে আছে ফজলু! ছোট্ট ঘেরা জায়গাটায় তীব্র ফুলের সুবাস ঘনিয়ে উঠেছে। কী মাতলা গন্ধ!
সমীরণ ডাকল না, কিন্তু ডাকটা উঠে এল তার আত্মার গম্ভীর থেকে, ফজলু! ফজলু রে! শুনছিস?