একদিন বিভাসই এসে খবর দিল, একটা লাইন পেয়েছি, বুঝলি। রায়বাবু নামে একজন বড় ব্যাবসাদার আছে, তার একজন গুন্ডা দরকার।
গুন্ডা! বলে খুব বিস্ময় প্রকাশ করেছিল সমীরণ।
বিভাস বলল, আমিই কাজটা নিতাম। কিন্তু একটা ভাল মোটর গ্যারাজে আমি মেকানিকের কাজ পেয়ে গেছি। তিনশো পঁচিশ টাকা প্লাস টিফিনের জন্য রোজ চল্লিশ পয়সা।
সমীরণ ভীষণ অবাক হয়েছিল। বিভাস কবে যে মোটর মেকানিকের কাজ শিখল! জিজ্ঞেস করতে বিভাস দুঃখের সঙ্গে বলল, আর বলিস না ভাই। দু’বছর আগে সরকারি চাকরির বয়সটা পেরিয়ে যাওয়ার পর মরিয়া হয়ে ড্রাইভিং শিখতে থাকি। মেকানিকের কাজ জানা থাকলে সফারের চাকরিও খারাপ নয়। তাই সবটাই শিখতে লাগলাম। এখন আমি একজন খুদে এক্সপার্ট। স্বাস্থ্য ভাল বলে খাটতেও পারি অসুরের মতো।
কিন্তু আমি যে কখনও গুন্ডামি করিনি।
গুল্ডা বলতে সেরকম ব্যাপার নয়। রায়বাবুর আসলে দরকার একজন বডিগার্ড গোছর লোক। অনেক ক্যাশ টাকা নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। তাছাড়া কয়েকটা তঁাদড় পার্টি আছে, তাদের মাঝে মাঝে ভয় দেখানো দরকার। রিস্ক নেই। শোন সমী, চুঁচিবায়ু-টায়ু ছাড়। শুনছিস তো দেশের জন্য যেমন প্রয়োজন তেমনভাবে সবাইকে তৈরি হতে বলা হচ্ছে। দেশের যখন ডাক্তার দরকার তখন বেশিরভাগ ছেলেকে ডাক্তারিতে শিক্ষিত করতে হবে, যখন উকিল দরকার তখন ওকালতি বাড়াতে হবে, যখন দেশে যেটার প্রয়োজন দেখা দেবে তখন আমাদেরও সেইভাবে তৈরি হতে হবে। যখন ইঞ্জিনিয়ার দরকার নেই তখন খামোকা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে দেশের বেকার সমস্যা বাড়ানো ঠিক নয়। কেমন, একথাটা মানছিস?
মানছি।
তবে আর বেগরবাই করছিস কেন? এখন বডিগার্ডের নেসেসিটি দেখা দিয়েছে। তোর স্বাস্থ্য ভাল। সুতরাং খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। দেশের প্রয়োজন, তুইও তৈরি।
সমীরণের রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। তিন বছর হল সরকারি চাকরির বয়স পার হয়ে গেছে। আর বয়স হলে কেউ বডিগার্ডও রাখবে না। তবে শুধু গায়ের জোরে যে বডিগার্ড বা গুন্ডা হওয়া যায় না এটা তার জানা ছিল।
কিন্তু রায়বাবু তাকে পছন্দ করলেন। বললেন, দেখো বাপু, মারপিট আমি পছন্দ করি না। ছোরাছুরি বা রক্তপাত এসবের প্রশ্নই ওঠে না। শুধু আওয়াজ দিয়ে কাজ সারবে।
এই বডিগার্ড রাখার ব্যাপারটা রায়বাবুর পার্টনার আচার্যিবাবু বেশি পছন্দ করেননি। বার বার বার রায়বাবুকে বলছিলেন, তোমার মাথাটাই খারাপ হয়েছে দেখছি।
রায়বাবু বললেন, চারদিকে কত চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই দেখছ তো! নেসকো, শিবু পান্ডা, কাতুচরণ এইসব পাটি বিল মেটাতে গোলমাল করছে, এদেরও একটু ভয় খাওয়ানো দরকার। আবার সেদিন তো দেখলে পুজোর চাঁদা বলে এ পাড়ার মস্তান ছেলেরা কেমন তিনশো টাকা আদায় করে নিয়ে গেল। কিছু করতে পেরেছিলে তার? একজন ডাকাবুকো লোক থাকলে এইসব এলিমেন্ট ঢিট থাকে। তবে মারপিটে নয়, শুধু হুম হাম।
আচার্যিবাবু খুশি হননি বটে তবে ব্যাবসাতে রায়বাবুর টাকাই বেশি খাটে, তার প্রভাবও, সুতরাং সমীরণ বহাল হল।
দুশো টাকা মাইনে, যাতায়াত আর জলখাবার বাবদ আরও পঁচিশ টাকা। ছুটি নেই, ইনক্রিমেন্ট বা বোনাসের প্রশ্ন নেই। তবে রায়বাবু ভরসা দিয়েছিলেন, কাজে খুশি করতে পারলে প্রোমোশন দেব। কিন্তু এ অফিসে প্রোমোশনই বা কী করে হবে তা ভেবে পায় না সমীরণ। রায়বাবু আর আচার্যিবাবু, এই দু’জনকে নিয়েই বলতে গেলে ব্যাবসা। বাইরের দু-চারজন আড়কাঠি কী সব খবরটবর এনে দেয়, কিছু সাব কনট্রাক্টর আছে, এ ছাড়া পাকা চাকরির লোক কেউ নেই। একা সারাদিন সমীরণ অফিস আগলে থাকে। বডিগার্ড বা গুন্ডার কাজ তাকে এখনও তেমন কিছু করতে হয়নি। খুব বড় কোনও পেমেন্ট থাকলে রায়বাবু তাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকে যান। বারবার বলে দিয়েছেন, যখন আমি ক্যাশ টাকা নিয়ে চলাফেরা করি তখন আমার গা শুকে এঁকে চলবে। কেউ কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করে কি না খুব লক্ষ রাখবে। তেমন বুঝলে আমার পিঠে আঙুলের খোঁচা দিয়ে সজাগ করে দেবে। আর কেউ ছিনতাই করবার তাল করছে দেখলে লাফিয়ে পড়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলটান মেরে পেড়ে ফেলবে। এই উপদেশ সমীরণ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে।
মুড়ি খেতে খেতে হাটছিল সমীরণ। কিন্তু অফিসের পথটা পেরোবার আগেই চিড়বিড়িয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ভারী পাজি বৃষ্টি। দেখতে তেমন কিছু নয়। কিন্তু দশ পা হাঁটলে ভিজিয়ে চুপসে দেবে।
সামনেই ফুটপাতের ওপর একটা ত্রিপল টাঙাননা, ত্রিপলের নীচে চৌকি পেতে কারা শুয়ে বসে আছে। লাল শালুতে কী সব যেন সাদা অক্ষরে লেখা। পড়ার সময় ছিল না, সমীরণ কোলকুঁজো হয়ে ত্রিপলের তলায় ঢুকে গা বাঁচায়। হাতে মুড়ির ঠোঙা। এক গাল মুড়ি মুখে দিয়ে প্রবল চোয়ালে চিবোতে চিবোতে হঠাৎ তার বিবেকে ঘা লাগল। দেখল, ত্রিপলের গায়ে দেয়ালে খবরের কাগজের পোস্টার সাঁটা। তাতে লাল কালিতে লেখা চাকুরিতে পুনর্বহালের দাবিতে রুবি আয়রন ফাউন্ড্রির কর্মীদের আমরণ অনশন।
সামনের দিকে একটা চৌকি অনেকটা খালি পড়ে আছে দেখে সমীরণ বসে পড়েছিল। ছ্যাচড়া বৃষ্টিটা অনেকক্ষণ চলবে। বসাই ভাল। কিন্তু বসার পর পোস্টারগুলো দেখে মুড়ি খেতে এখন তার সত্যিই লজ্জা করছে। একটা বড় সাদা কাগজে লেখা অনশনের আজ ৩ দিন। তিন দিনই হবে। গত পরশুও সমীরণ এই ত্রিপলটা টাঙানো দেখেছে, তখন অত শত লক্ষ করেনি।