স্বপ্নে পারি। আমাকে আবার স্বপ্নে নিয়ে যাও।
পৃথিবীর প্রতিটি দুঃখী মানুষ তোমাকে যে ডাকছে বৌধায়ন।
আমাকে কেন? আমাকেই কেন? যা করার সরকার করুক। জানো না, আমেরিকায় এরকম হয়? রাশিয়ায় হয় না। ইউরোপে হয় না। শুধু এই জঘন্য দেশে হয়। আমি কী করব?
বৌধায়ন আস্তে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। না, সে পারবে না। সে মহৎ নয়। সে বড় সাধারণ। আর এই বোধ তার বুক খামচে ধরে থাকে অনেকক্ষণ।
বৌধায়ন ভাবে, আজ পারল না সে। কিন্তু একদিন পারবে। একদিন সে ঠিক পারবে। পৃথিবীর আর্ত মানুষেরা তার জন্যই হয়তো অপেক্ষা করছে। একদিন সে-ই হয়তো হবে মানুষের মুক্তিদাতা?
বেলা দশটা নাগাদ বৌধায়ন মন্দার বাবার অফিসের তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল।
সেই থেকে রাগ করে বৌধায়ন আর কখনও মাকে ফোন করেনি। কিছু জানতে চায়নি। আশ্চর্য এই যে মন্দাও তাকে খবর দেয়নি কিছু। যদি মন্দাকে পায় আজ তবে কিছু কথা শোনাবে সে।
সামনের ঘরটায় সমীরণ নামে সেই লোকটা বসে আছে। তাকে দেখে একটু থমকে গেল বৌধায়ন। লোকটার ওপরের ঠোঁটে একটা মস্ত স্টিকিং প্লাস্টার প্লাস্টারের তলা দিয়েও ফোলা কাটা রক্তাক্ত মাংস দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো লাল। চুল উসকো খুসকো।
লোকটা বসে ছিল, তাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়।
বৌধায়ন ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করে, মন্দা আসেনি?
না।
কখন আসবে?
লোকটা বিক্ষত মুখে কষ্ট করে বলে, কাল সকাল থেকে বসে আছি। বলেছিলেন ফিরবেন। ফেরেননি।
স্তম্ভিত হয়ে বৌধায়ন বলে, আপনি কাল থেকে আছেন?
লোকটা হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ। উনি বলেছিলেন, আমাকে দরকার হতে পারে। যেন থাকি।
অথচ আসেনি?
না।
রাগে আপন মনে খানিকটা গরম হয়ে গেল বৌধায়ন। বিড়বিড় করে বলল, কী চায় ও? কী চায়?
আজ্ঞে?
কিছু খেয়েছেন?
খেয়েছি। রুটি তরকারি। রাতে সুখন দিয়েছিল।
আজ?
পাউরুটি আর চা।
মন্দা কোনও খবর দেয়নি?
বেলা তিনটায়, রাত আটটায় আর সাড়ে এগারোটায় ফোন করেছিলেন।
কী বলল?
শুধু বললেন, আমি যেন থাকি। আমাকে ওঁর দরকার হবে।
আপনি তো মশাই ক্যাসাবিয়াঙ্কা। ও বলল বলেই আপনি বসে রইলেন?
কী করব? চাকরি।
বৌধায়ন লম্বা কাঠের বেঞ্চটায় বসল। দাতে দাত চেপে রাগ সামলাতে লাগল। আর বসে বসে জগতের যত কিছু অন্যায় আর অবিচারের কথা ভাবতে লাগল। এক্ষুনি কিছু একটা করা উচিত। সব কিছুর একটা আমূল ওলট পালট দরকার।
একটু বাদে রাগটা থেমে গেল খানিকটা। নরম স্বরে সে লোকটাকে জিজ্ঞেস করে, আর কিছু খাবেন? আমি খাওয়াতে পারি।
খুব লজ্জিত ভঙ্গিতে লোকটা বলে, না। তারপর একটু চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলে, খাওয়াটা কোনও সমস্যাই নয়। এমন দিন আসবে যখন মানুষ না খেয়েই থাকতে পারবে। খুব গোপনে একটা এক্সপেরিমেন্ট চলছে।
ব্যাপারটা বুঝতে পারল না বৌধায়ন। আর একটু খোলসা করে বলতে বলল। কিন্তু ঠিক এ সময়ে সিড়িতে খুব দ্রুত লঘু পায়ের শব্দ হল। পরমুহূর্তেই ঝড়াক করে একরাশ সুগন্ধ, সৌন্দর্য আর চঞ্চলতা নিয়ে ঘরে এল মন্দা।
বৌধায়ন! হোয়াট এ সারপ্রাইজ! ওঃ ওঃ বৌধায়ন, তোমার কাছে আমার একটা ক্ষমা চাওয়া বাকি আছে। আই অ্যাম সরি, ভেরি ভেরি সরি ফর দ্যাট ইনসিডেন্ট।
বৌধায়ন গম্ভীর গলায় বলে, মন্দা, তুমি এই ভদ্রলোককে কাল থেকে অফিসে আটকে রেখেছ। আগে ওঁর কাছে অ্যাপোেলোজাইজ করো।
সে কী!— বলে মন্দা নাগরদোলার মতো পাক খেয়ে সমীরণের মুখখামুখি হয়ে বলে, আপনি কাল বাড়ি যাননি?
না। আপনি থাকতে বলেছিলেন।
কিন্তু তা বলে বাড়ি যাবেন না কেন? থাকতে বলেছিলাম, কিন্তু সে তো সারা রাত নয়। এ মা। কী বোকামি বলুন তো! ছিঃ ছিঃ আমারই দোষ।
সমীরণ মনে মনে মাকে ভালবাসে। হ্যাঁ, বাসে। কোনও ভুল নেই। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, মন্দা কি ঘটনাটা মনে রেখে রায়বাবুকে জানাবে? রায়বাবু কি বুঝতে পারবে যে সমীরণ কী ভীষণ সিনসিয়ার। কত সৎ! কাজের লোক! আর এই রকমভাবে বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে পারলে সে কি রায় আচার্যির পার্টনার হতে পারবে না? যদি হতে পারে তাহলে মন্দা…? একদিন মন্দাকে কি সে …? মানে মন্দা তাকে কি…?
সমীরণ খুব বিনয়ের সঙ্গে বলে, আমার কোনও অসুবিধে হয়নি।
তা বলে বাড়ি যাবেন না কেন বলুন তো? চাকরির জন্য কে সারা রাত খামোকা থাকে বলুন? যাঃ আমার ভীষণ লজ্জা করছে। আই অ্যাম সো সরি!… জানো বৌধায়ন, ব্যাপারটা কী, আমি আজকাল ভীষণ, কী বলব আনক্যানি ফিল করি। একা হলেই মনে হয়, কী একটা বিপদ ঘটবে। মনে হয় কে যেন পিছু নিয়েছে… সেই যে তোমাকে ফোন করেছিলাম… (খিল খিল করে হাসি) ইস, বোলো না বোলো না সে যা একখানা কাণ্ড না! একদম বুন্ধুর মতো। .. এসো এ ঘরে বসবে এসো। অনেক কথা আছে…
বলতে বলতে মন্দা গিয়ে দরজায় চাবি ঢোকায়। মুখ ঘুরিয়ে সমীরণকে বলে, আমি কিন্তু ধরে নিয়েছিলাম, আপনি ঠিক চলে যাবেন। কেন গেলেন না বলুন তো? এখন যে কী ভীষণ লজ্জা করছে আমার। তার ওপর কাল রজত আপনাকে বিশ্রীভাবে উনডেড করেছে। এ টি এস নিয়েছিলেন তো?
সমীরণ ব্যগ্রভাবে বলে, না, না, ও কিছু নয়। আমার ওসব অভ্যাস আছে। কাল যে টাকা দিয়েছিলেন তার থেকে চার টাকা বাইশ পয়সা ফিরেছে।
রাখুন তো৷ ফেরত আর কী!…জানো বৌধায়ন, কাল রাতের ব্যাপারটার জন্য তুমি আমাকে দোষ দেবে জানি, ইউ আর সো মাচ মরালিস্ট, কিন্তু জানো তো রজত সঙ্গে থাকলে ইউ ডোন্ট ফিল দা টাইম। ও এত টগবগে করে রাখে যে ক’টা বাজল তা খেয়ালই থাকে না। আমি যে লাস্ট ক’টার সময় সমীরণবাবুকে টেলিফোন করেছিলাম তা-ই মনে নেই। দুপুর থেকে হুল্লোড়। সুব্রত এল, বিজিত এল, লোপা এল, তারপর কেবল হুল্লোড়। একটা রেস্টুরেন্ট থেকে আমাদের খুব ভদ্রভাবে বেরিয়ে যেতেও বলেছিল, জানো? কিন্তু একটু বোর করেনি। কী যে দারুণ ডাইনামিক না রজত। আর কী ড্রিংক করতে পারে জানো? কারও অত মুরোদ নেই। দুপুর থেকে একটানা খেয়ে গেল উইদাউট ব্যাটিং অ্যান আই লিড। রাত বারোটার সময়েও পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিল। এক রাতে কত খরচ করল জানো? আমরা পাঁচজন ছিলাম, পাঁচজনের জন্যে রজত বিল মেটাল দেড় হাজার টাকার কিছু বেশি।