জয়তী টপ করে বৌধায়নের ডান পা চেপে ধরে বলে, হামি খাওয়ার কথাটা উইথড্র করবে কি বলো! না করলে…
বৌধায়ন প্রাণপণে পা-টা স্থির রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে ডান পাটার দিকে চোখের ইঙ্গিত করে বলে, আর ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়। বুঝলে? পা কমপ্লিটলি সেরে গেছে। আজ সোনলা ওয়াকিং এ বেরোচ্ছি।
জয়তী পা ছেড়ে দিয়ে বলে, সাবালক হলে তাহলে! আসলে ব্যথা না আরও কিছু। ঢং করে ক’দিন অন্যদের সিমপ্যাথি আদায়ের চেষ্টা।
যা সিমপ্যাথি দেখিয়েছ আর বোলা না। যাক গে, আজ সবাইকে ক্ষমা করছি। আজ আমার মিসা থেকে মুক্তি। আজ সমস্ত পৃথিবীটা আমার। যাও বৎসে, তোমার স্ত্রী-সর্বস্ব স্বামীটাকে হামি দিয়ে অফিসে পাঠাও গে।
কাপের তলানি চা-টুকু নিখুঁত লক্ষ্যে বৌধায়নের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে জয়তী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আজ সত্যিই বেরোল বৌধায়ন। বাড়ির বাইরে পা দিয়েই তার মনে হল, কী মুক্ত এই পৃথিবী! কী বিশাল প্রসারিত চারিধার!
একটু খোঁড়াচ্ছে সে এখনও। গোড়ালির হাড়ের গভীরে একটু ব্যথা ঘাপটি মেরে আছে। তবু বড় ভাল লাগছিল তার। এখন সে একা বেরোতে পাবছে। কত জায়গায় যাওয়ার আছে তার! কতজনার সঙ্গে দেখা করার আছে!
প্রথমে কোথায় যাবে, কার সঙ্গে দেখা করবে তা ঠিক করতে পারছিল না সে। একবার ভাবল, রেনি পার্কে বড়দার নতুন কেনা ফ্ল্যাটে গিয়ে ওদের সঙ্গে কাটিয়ে আসে, আবার ভাবল কোনও বন্ধুর কাছে গেলে কেমন হয়? শেষ পর্যন্ত ঠিক করল বিছানায় দীর্ঘ বন্দিদশা থেকে মিসা থেকে যে মুক্তি, আজ সে বহু দূর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে সেই অবারিত মুক্তিকে অনুভব করে বেড়াবে। অসুখ বা দুর্ঘটনা বা জেল না হলে বোঝাই যায় না যে বেঁচে থাকাটা কী ভীষণ ভাল!
সকাল থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়েছে বৌধায়ন। কারণ, নতুন করে একা একা, স্বাধীনভাবে চারধার দেখবে সে এতদিন পরে। সকালের আলোটাই ভাল। সব কিছু তাতে অন্যরকম দেখায়।
সে বড় রাস্তায় একটা ট্যাক্সি পাকড়াও করল আর মানিকতলা থেকে শিয়ালদা আসতে আসতে সে তিনটে বাচ্চা ন্যাংটো ছেলেমেয়েকে ফুটপাতে রাস্তার দিকে পিছন ফিরে বসে হাগতে দেখল। দেখল, রাস্তায় স্নান চেহারার ক্ষয়া আধমরা মানুষ গিসগিস করছে। স্টেটবাসের গায়ে পুরু ধুলোর মলিন আস্তরণ। নতুন সিনেমার পোস্টারে হুমদো হুমদো নায়ক-নায়িকার বিকট চড়া রঙের ছবি ঝুলতে দেখল সে। তার নীচে রাস্তার হাইড্র্যান্টের ঘোলা জলে স্নান করছে বুড়ো বাচ্চা কিছু মানুষ। অত রঙের নীচে বড় বেমানান। দেখল, বস্তিকে আড়াল করে বিশাল আধুনিক বাড়ি উঠছে। ফরসা জামা চড়িয়ে হেঁড়া গেঞ্জি ঢাকা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে ফোলোবাবু কলকাতা।
মুক্ত মিসা-বন্দির চটকা ভেঙে গেল বৌধায়নের। সে সিটে এলিয়ে থেকে চোখ বুজল। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, ময়দান।
কোথাও অবশ্য নামল না, বৌধায়ন। চক্কর মারতে লাগল এদিক সেদিক। ময়দান ছাড়িয়ে চলে এল দক্ষিণে। এক জায়গায় ট্যাক্সি দাড় করিয়ে রেখে চা আর অমলেট খেয়ে এল। ঘুরতে ঘুরতে আবার ময়দান, চৌরঙ্গি।
ট্যাক্সির ভিতরটা নিজের শ্বাসে ভেপে উঠছে দেখে বৌধায়ন ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। একটু হাঁটবে স্বাধীনভাবে। বেড়ানো যাকে বলে। মুক্তি যাকে বলে। খোলা আলো আর বাতাস নিবিড় আলিঙ্গনে ভালুকের মতো চেপে ধরুক তাকে।
আর এসপ্ল্যানেডে মেট্রোর উলটোদিকেই তার জন্য ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছিল দৃশ্যটা। ঘুরে ঘুরে সে এল এইখানেই।
তেমন কিছু নয়। রোজই দেখা যায়। তবু এতদিন বাদে বড় কাছ থেকে আবার দেখল বৌধায়ন। মেট্রোর উলটোদিকে গাছতলায় একটা বোগা ভিখিরি ছেলের শ্বাস উঠেছে। শুধু হাফপ্যান্ট ছাড়া তার পরনে কিছু নেই। সেই হেঁড়া হাফপ্যান্ট দিয়েও তার নুঙ্কু দেখা যায়। তার চেয়েও অশ্লীল দৃশ্য হল, তার বুকের পাঁজরের ওপর দিয়ে সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার হৃৎপিণ্ডের ঢেউ। এত রোগা মানুষ হয়? আজ পর্যন্ত যত রোগা লোক দেখেছে বৌধায়ন তার মধ্যে এ সবচেয়ে বেশি নম্বর পাবে। গায়ে তেলচিটে ময়লা, গাঁটে গাঁটে অজস্র মাছি-বসা ঘা। একটা ন্যাকড়ার ফালিও জোটেনি বলে সোজা পথের শানের ওপর পড়ে আছে কাত হয়ে। মুখের সামনে শুকনো বমি, মলে মাখামাখি নিম্নাঙ্গ।
চলে যাওয়াই উচিত বৌধায়নের। তবু পাঁচ হাত দূরে সে ক্ষণকালের জন্য হলেও থামল। নিজেকেই জিজ্ঞেস করল, পারবে বৌধায়ন, ওকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে?
না।
স্বপ্নে কাল কিন্তু একজন আহতকে নিয়েছিলে তুমি।
আমাকে আবার স্বপ্নের মধ্যে নিয়ে যাও। তাহলে পারব। স্বপ্নে পারি। স্বপ্নে সব পারি।
বাস্তবে পারো না?
কিন্তু আমি মানুষের জন্য ভীষণ ফিল করি। আমি বিশ্বাস করি, এর জন্য কিছু করা দরকার। খুব দরকার। বিদ্যাসাগর পেরেছিলেন, মা টেরেসা পারেন। আমি কেন যে পারি না!
কিন্তু বুঝে দেখো বৌধায়ন, ও ছেলেটা তোমার জন্যেই পড়ে আছে না কি? তোমাকেই কি ডাকছে না? ও মরে যাচ্ছে বৌধায়ন। সারা দিন ওর পাশ দিয়ে কত লোক হেঁটে চলে যাবে। ফিরে তাকাবে, হয়তো একটু থামবে, ইতস্তত করবে কেউ কেউ। কিন্তু চলেই যাবে শেষ পর্যন্ত। তুমিও যদি তাই করো তবে তুমিও ভিড় হয়ে গেলে, সাধারণ হয়ে গেলে ইনসিগনিফিক্যান্ট হয়ে গেলে।