হাসপাতালের রাস্তা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না বৌধায়ন। এই বিপুল মধ্যরাতের শহরে কোনদিকে যে নিকটবর্তী হাসপাতাল তা সে জানেও না।
পিছু পিছু একটা লোক আসছে টের পেয়ে বৌধায়ন ফিরে তাকাল। বেঁটেখাটো ধূর্ত একটা লোক। আসলে শেয়াল। গোঁফের ফঁাকে হাসছে। চোখে মিটমিটে জোনাকি।
কে?
কিছু নয় স্যার।
ওর আংটিটা আর ঘড়িটা নেব স্যার?
বৌধায়নের দম বন্ধ হয়ে আসে। কাটা হাতটা তুলে সে কুকুর তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলে, হ্যাট! হ্যাট!
লোকটা সরে যায়।
কিন্তু আশ থেকে পাশ থেকে ছায়ার মতো লোকেরা আসছে। অদ্ভুত লোক সব। ঠিক মানুষ নয়। শেয়ালের মতো। তাদের একজন চাপা স্বরে বলে, লাভ নেই। ওর হয়ে গেছে। টেরিলিনের জামাটা খুলে দিন না! নইলে হাসপাতালের ধাঙড়রা তো নেবেই।
বৌধায়ন কাটা হাতটা তোলে লাঠির মতো! কিন্তু তার গায়ে রত্তি জোরও নেই। সে ঘামছে। প্রবল এক মানসিক জোরে সে চেঁচিয়ে বলে, খবরদার!
কিন্তু হাসপাতাল কোন দিকে? হাসপাতাল কত দূর?
এক-আধটা বেশি রাতের ট্যাক্সি আশপাশ দিয়ে ধীর গতিতে চলে যাচ্ছে। প্রাণপণে কাটা হাতটা তুলে ধরে বৌধায়ন ট্যাক্সি থামাতে বলে। আতঙ্কিত ট্যাক্সিওয়ালারা থামে না।
লোকটা গভীর স্বরে পেট থেকে গোঙানি তুলে আনে। একবার বলে জল’, আর একবার বলে বাড়ি যাব’। দিগভ্রান্ত বৌধায়ন প্রাণপণে হাঁটে। কোথায় যাচ্ছে তা বুঝতে পারে না।
তার পিছনে লোভী শেয়াল-মানুষেরা দল বাঁধছে, জোট বাঁধছে ফিসফিস করে কথা বলছে, হাসছে খিকখিক করে। বৌধায়ন কাটা হাতটা তুলে বলে, হ্যাট! হ্যাট!
কিন্তু লোকগুলো ঘিরে আসে। মেঘের মতো ঘনিয়ে ওঠে চারদিকে। থমথম করতে থাকে চারপাশ। বিপদ!
বৌধায়ন আতঙ্কে পাগল হয়ে যায়। কাঁধ থেকে লোকটাকে ফেলে দিতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু লোকটা তখন একটা হাত আর দুটো পায়ে তাকে আঁকড়ে ধরেছে প্রাণপণে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে বৌধায়নের। সে চেঁচাতে থাকে, বাঁচাও! বাঁচাও!
.
এত ভোরে ঘুম ভাঙে না বৌধায়নের। দুঃস্বপ্নটা দেখে ভাঙল। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলে মানুষের যা যা হয় তারও তাই তাই হল। যেমন প্রথমটায় সে কিছুক্ষণ বুঝতেই পারল না, ব্যাপারটা সত্যি না মিথ্যে। তারপর স্বপ্ন বুঝেও অনেকক্ষণ আতঙ্ক গেল না তার। তারপর জল খেল। আবার ঘুমোবার চেষ্টা করল।
সারা সকালটা গুম হয়ে ছিল সে। স্বপ্নের পর প্রথম জ্যান্ত মানুষ দেখল সে, যখন জয়তী চা দিতে এল।
বিনা ভূমিকায় বৌধায়ন বলল, কলকাতায় স্বরূপটা কি জানো?
জয়তী খুব অবাক ভান করে বলে, না তো! বলবে?
বৌধায়ন মুখ বিকৃত করে ডান পা-টা সরিয়ে বলল, বোসো, বলছি।
তাহলে একটু অপেক্ষা করো, ঘড়িটা হাতে পরে আসি।
কেন?
ঘুঘুটা কতক্ষণ ডাকবে কে জানে। কিন্তু ঘুঘুর ডাক শুনতে গিয়ে আমার কর্তার অফিসের বেলা না বয়ে যায়।
বৌধায়ন রেগে গিয়ে বলে, এ বাড়িটা কী বলো তো? একজনও সিমপ্যাথাইজার নেই আমার। সারাদিন একা ঘরে পড়ে থাকি, একটা জ্যান্ত লোকের মুখ দেখি না। এর পর বাস্তবিক আমার ভূতের ভয় করতে শুরু করবে।
জয়তী তার ঘুম-ভাঙা মসৃণ মুখে মধুর একটু হেসে বলে, তোমার জন্য সিমপ্যাথিতে রাতে আমার ভাল ঘুম হয় না, জানো?
ওঃ! রাতে কেন ঘুম হয় না সে আমার জানা আছে। বেশি বোকো না। নিজে ঘুমোও না, বুধাদিত্য বেচারাকেও ঘুমোতে দাও না। জানি।
জয়তী ব্যথিত মুখে বলে, ছিঃ! গুরুজনদের সম্পর্কে অসভ্য ইঙ্গিত করতে নেই। কলকাতার স্বরূপটা কী বলছিলে যেন! আচ্ছা, না হয় একটু বসেই যাই।
জয়তী বসল। বৌধায়ন চা শেষ করে কাপটা নামিয়ে রেখে বলে, হেসো না, সবটা শোনো। স্বপ্ন হলেও ইট ওয়াজ দা রিভিলেশন অফ টুথ। কী দেখলাম জানো? আমি মাঝ রাতে একটা আহত লোককে কাধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি… হাসপাতালে… কিন্তু রাস্তা চিনতে পারছি না.. আর অবিকল শেয়ালের মতো কিছু লোক সেই উনডেড লোটার ঘড়ি আংটি আর জামাকাপড় কেড়ে নেওয়ার জন্য তাড়া করেছে… আমি লোকটাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লোকটা তখন আমাকে ছাড়ছে না… তাকিয়ে আছে যে।
আমার চোখে পাপ নেই।
তা না থাক, কিন্তু ব্যঙ্গ আছে। তুমি কি সিরিয়াস জয়তী?
আবার জয়তী?
সরি। বউদি। ব্যাপারটা কী জানো? আমি স্বপ্নটা অ্যানালাইজ করে দেখলাম, কলকাতা এখন। একজ্যাক্টলি ওই স্বপ্নের মতো। কলকাতাকে দুঃস্বপ্নের শহর কে বলেছিল বলো তো!
নেহেরু।
তোমার মাথা। বলেছিল… বলেছিল— বৌধায়ন চোখ তুলে ভাবে।
প্যাটেল। জয়তী বলে।
বৌধায়ন হতাশ হয়ে বলে, প্যাটেল বললে কাউকেই বোেঝায় না। কোন প্যাটেল? বল্লভভাই হতে পারে, আরও কত প্যাটেল আছে।
জয়তী করুণ মুখ করে বলে, তুমি কি শেষ পর্যন্ত সংসারে থাকবে বুধো? বুদ্ধের মতো গৃহত্যাগ করবে না তো!
মানে?
আজকাল যে মানুষের জন্য তোমার ভীষণ প্রাণ কাঁদছে। জেগে ঘুমিয়ে সব সময়েই যে তুমি মানুষের বিপদে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছ। ব্যাপারটা কী বলল তো? স্বপ্নে উনডেড লোককে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছ, এই সেদিন বিনা স্বপ্নে মন্দাকে উদ্ধার করতে লাঠি নিয়ে… ছিঃ ছিঃ… বাবা রে বাবা! পারোও তুমি।
বৌধায়ন নিমীলিত চোখে চেয়ে বলে, আমি কত মহৎপ্রাণ মানুষ ছিলাম তা আজ বুঝলে না জয়তী, কোনওদিন বুঝবে। এখন যাও কর্তাকে নেকারবোকার পরিয়ে, চোখে কাজল টেনে, হামি খেয়ে অফিসে পাঠাও গে যাও। তোমরা ফিলানথ্রপির বোঝো কী? আত্মসুখী সংসারী সব।