চারদিকে বিস্তর লোক ভিড় করে এসেছে। ভিড় ঠেলে বন্দুক কাধে দারোয়ান এগিয়ে এসে বলে, খাড়া রহিয়ে। পুলিশ আ রহা হ্যায়।
মন্দা লোকটার দিকে চেয়ে বলল, দ্যাট এগেইন উইল টিচ ইউ এ লেসন। যাও এবার জাহাজের ভাত খাওয়ার পর জেলের ভাতটাও খেয়ে এসো। ছিঃ ছিঃ হোয়াট এ সিন!
রজত অবশ্য ঘাবড়ায় না। অতি দ্রুত ফটাফট ইংরিজি বাংলায় সে কথার তোড়ে ভিড় হটিয়ে দেয়। ব্যাঙ্কের বুড়ো ম্যানেজারকে কাধ ধরে খুব আপন করে বুকে টেনে নিয়ে কানে কানে কী বলে বোঝাতে থাকে। এবং ভিড় পাতলা হতে থাকে। উত্তেজনা হ্রাস পায়। সদর দরজা খুলে যায়। ব্যাঙ্কে কাজকর্ম আবার শুরু হয়।
তারা তিনজন বেরিয়ে এসে গাড়িতে ওঠে। সামনে রজত আর মন্দা। পিছনে রক্তঝরা মুখে সমীরণ। তার খুব খারাপ লাগছে না। তবে ব্যাপারটা ভাল হল না মন্দ হল তা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। একবার তার মন বলে, ভালই হল। আবার বলে, না ততটা ভাল কিছু হল না হে। যত যাই হোক নোকটা তো মন্দার বন্ধু!
মন্দা গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, সেইলাররা জাহাজ থেকে নামার পর কিছু দিন ভীষণ সেক্স হাজারে ভোগে রজত। আমি এখন তোমাকে ভয় পাই।
সা-জোয়ান রজত গ্যাল গ্যাল করে হেসে বলে, ননসেন্স। আমি কি মালের জাহাজের খালাসি? আমি প্যাসেঞ্জার লাইনারের ইঞ্জিনিয়ার, মনে রেখো। আই হ্যাড প্লেন্টি অফ গার্লস।
গড!–মন্দা হেঁচকি তুলে বলে, তবে আমার জন্য অত হ্যাংলামি করলে কেন? দেখো তো, প্র্যাকটিক্যাল জোক করতে গিয়ে আমাদের সিকিউরিটি ভদ্রলোকের কী অবস্থা করেছ।
ভদ্রতা করে পিছন থেকে ফাটা ঠোঁটে অতি কষ্টে সমীরণ বলে ওঠে, না, না, কিছু হয়নি।
রজত বলল, আই অ্যাম সো সরি! কী জানো, জাহাজ ইংল্যান্ড ছাড়বার পর থেকেই তোমার কথা এত মনে হচ্ছিল।
এ কালারফুল লাই।
বোকা-হাসিটা মুখে রেখেই রজত বলে, আমি আসায় তুমি খুশি হওনি মন!
মন্দা অফিসের কাছাকাছি একটা ডাক্তারখানার সামনে গাড়ি দাড় করিয়ে পিছন ফিরে সমীরণকে বলে, আপনি বরং কাটা জায়গাটায় একটু ওষুধ লাগিয়ে নিন এখান থেকে। একটা এ টি এস ইঞ্জেকশনও নেবেন। এটা রাখুন।-বলে দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয়।
ভারী কৃতজ্ঞতার সঙ্গে নোটটা নিয়ে নেমে পড়ে সমীরণ। মুখটা ফুলে গেছে। ব্যথা হচ্ছে খুব।
মন্দা মুখ বাড়িয়ে বলল, আর শুনুন, অফিসে থাকবেন। আমার হয়ত আপনাকে দরকার হবে।
এই বলে মন্দা গাড়ি ছাড়ল, আর ছাড়বার মুহূর্তে চাপা গলায় রজতকে বলল, নাউ আই উইল সি হাউ মাচ ইউ মিসড মি!
রজত গ্যাল গ্যাল করে হাসছিল।
.
০৮.
গভীর রাতে লোকটা ট্রাম লাইনের ওপর পড়ে আছে। একটা হাত কাটা, একটা পা খ্যাতলানো, কোমর ভাঙা। কাতরাচ্ছে গভীর গভীরতম মৃত্যুযন্ত্রণায়। নিজের রক্তের পুকুরে সাঁতরাচ্ছে, ড়ুবে যাচ্ছে।
বৌধায়ন চোখ ফেরাতে পারে না, তার ঘাড় শক্ত হয়ে আছে। ফুটপাথে বসে থাকা একটা ভিখিরির মতো চেহারার লোক মুখ থেকে বিড়িটা সরিয়ে থুথু ফেলে থিকথিক করে হেসে বলল, এইমাত্তর লাস্ট ট্রামটা মেরে দিয়ে গেল। ও আর দেখতে হবে না, হয়ে গেছে।
বৌধায়ন রক্ত দেখতে পারে না, কাটা ছেড়া শরীরের দিকে তাকাতে পারে না। কলকাতার রাস্তায় প্রায়ই এখানে সেখানে পড়ে থাকে মানুষজন। তাদের কী হয়েছে তা কখনও জানবার চেষ্টা করে না বৌধায়ন। নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ও কিছু নয়, লোকটা বোধহয় ঘুমোচ্ছ। এই ভেবে সে তাড়াতাড়ি জায়গাটা পার হয়ে যায়।
নিজের এই কাপুরুষতা বড় কষ্ট দেয় তাকে। তবু আজ সামনে এই জাজ্বল্যমান দৃশ্যটা দেখে সে পালাতে পারে না। লোকটা এখনও বেঁচে আছে। হাসপাতালে নিলে হয়তো বেঁচে যেতে পারে।
বিদ্যাসাগর কলেরার রুগি কাঁধে করে নিয়ে গিয়েছিলেন, মাদার টেরেসা আজও কুষ্ঠরোগীর সেবা করেন। সে পালাবে?
সাহস নয়, কিন্তু ভীষণ একটা মরিয়া ভাব এল তার। পারতেই হবে। যদি তার নিজের কোনওদিন এ দশা হয় তখনও তো এমনি তাকে পড়ে থাকতে হবে নির্জন রাস্তায়! হলহল করে কলখোলা জলের মতো রঙের ধারায় তৈরি হবে পুকুর।
বৌধায়ন আর ভাবে না। গোড়ালি-ড়ুব রক্তের পুকুর থেকে নিচু হয়ে কাটা, ভাঙা ঘঁাতলানো শরীরটাকে তুলে নিতে চেষ্টা করে। রক্তে ভিজে পিছল শরীরটা হড়কে যায় বার বার, লোকটা। গোঙায়। কী গভীর শব্দ যন্ত্রণার! বৌধায়নের সমস্ত শরীর অন্যের রক্তে, স্বেদে, শরীরের ঘামে ভিজে যেতে থাকে। ঘেন্নায়, ভয়ে তার শরীর কাপে রি-রি করে। কিন্তু প্রাণপণে দাঁতে দাঁত দিয়ে সে লোকটাকে কাঁধে নেয়।
কোনদিকে কত দূরে হাসপাতাল তা জানে না বৌধায়ন। ভারী নির্জন রাস্তা। ঠিক নির্জন নয়, ফুটপাথ থেকে আনাচ কানাচ থেকে কাঙাল, গরিব, বদমাশের চোরা-চোখ তাকে লক্ষ করে। শেয়ালের মতো ধূর্ত চোখ সব। চোখগুলি শ্রদ্ধায় বা বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয় না, কেবল নিস্পৃহ কঠিন দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকে দেখে। তারপর উদাস ভঙ্গিতে তারা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাই তোলে।
বৌধায়ন হাঁটতে থাকে। লোকটা ঝুলছে গোঙাচ্ছে। কাটা হাতটা ফিতের মতো পাতলা একটু চামড়ার সঙ্গে লেগে ঝুলছে। থপ করে হাতটা খসে পড়ে গেল। নিচু হয়ে ঠান্ডা, শক্ত হাতটা কুড়িয়ে নেয় বৌধায়ন। হাতটা বেশ লম্বা। অনেকটা লাঠির মতো সেটাতে ভর দিয়ে দিয়ে এগোতে পারে সে।