ও কী!–বলে মন্দা ভীষণ বিরক্ত হয়ে ফিরে দেখে।
কিন্তু তাকে কিছু বলার বা বোঝনোর সময় পায় না সমীরণ। ফ্রেঞ্চকাট নোকজনের পিছনে মাথা নামিয়ে লুকোয়। তার পরের মুহূর্তেই সে মন্দার পিছন দিকটায় বাতাস খুঁড়ে আবির্ভূত হয় এবং হাত বাড়ায়।
সমীরণ বিড় বিড় করছিল, লাফ … কোমর পেঁচিয়ে ধরো… বলটান মারো… পেড়ে ফেলো…
বালিশ লক্ষ করে সে এ তাবৎকাল কম লাফায়নি, কমবার কোমর পেঁচিয়ে বলটান মেরে পেড়ে ফেলেনি। এতদিনে পরিশ্রম সার্থক।
কালীঘাটের কালীকে মনে মনে স্মরণ করে সে অস্ফুট স্বরে ‘জয় কালী’ বলে লাফ দিল। গোলকিপারের ডাইভ দেওয়ার মতো চমৎকার নিখুঁত লাফা লাফিয়েই দু’হাতে লোকটার কোমর পেয়ে গেল সে।
প্রবল গুঁতোয় লোকটা বেসামালভাবে ভাঁজ হয়ে যাচ্ছিল। আর তক্ষুনি পায়ের নীচে জমি পেয়ে সমীরণ প্রাণপণে বলটান মেরে পেড়ে ফেলল।
একেবারে কুমড়ো গড়াগড়ি কাণ্ড। গদাম, ধপাস, ঠকায় নানারকম শব্দ হল। এবং সমীরণ টের পেল, লোকটা চিত হয়ে পড়েছে। সে নিজে লোকটার ওপর পড়ে আছে, কোমর তখনও দু’হাতে ধরা।
চারদিকে বিকট হইচই শব্দ উঠল। হড়াস করে সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। লোকজন পালাচ্ছে চারধারে।
সমীরণকে কেউ বাহবা দিচ্ছিল না। কিন্তু নিজের নিখুঁত লাফ, কোমর পেঁচানো এবং বলটান দিয়ে পেড়ে ফেলা দেখে সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে আপমনমনে বলে উঠল, সাবাশ! চমৎকার!
কিন্তু মুশকিল হল এর পর কী করতে হবে তা রায়বাবু তাকে কোনওদিনই বলে দেননি। বলটান মেনে পেড়ে ফেলা পর্যন্ত সে নিখুঁতভাবে করেছে, কিন্তু এর পরে কী? এইভাবেই কি পড়ে থাকতে হবে? নাকি এর পর লোকটা সম্পর্কে আর কোনও ব্যবস্থা নিতে হবে?
ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সমীরণ। আর তার দুহাতে ধরা সা-জোয়ান লোকটা ততক্ষণে তার মাথার কুয়াশা কাটিয়ে উঠেছে, পরিস্থিতিটা আঁচ করেছে এবং তারপর সেও এক বলটান দিয়েছে।
এক বলটানেই লোকটা সমীরণের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। তার গায়ে গোরু-খাওয়া জোর। সমীরণ প্রাণপণ চেষ্টাতেও তাকে ধরে রাখতে পারল না।
লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে, আর সমীরণও হামাগুড়ি দিয়ে উঠছে। লোকটা হঠাৎ সেই অবস্থায় পটাং করে ডান পায়ের একটা লাথি চালিয়ে দিল সমীরণের মুখে। সঙ্গে একটা গালাগালও দিল, কিন্তু সেটা ভাল শুনতে পেল না সে। শুন্যে আর একটা বলটান খেয়ে সে পড়ল। মেঝেতে তার হাড়গোড় আর মাংস এ্যাতোনোর শব্দটা স্পষ্ট শুনল সে। মাথাটা ভোম হয়ে গেল।
কিন্তু সমীরণ জানে, এখন যদি সে হাল ছেড়ে দেয় তবে তার অপদার্থতাই প্রমাণ হবে। হেরো বডিগার্ড বা ভূপাতিত সিকিউরিটি অফিসার কোনও কাজের নয়। যদি সে অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যায় তবে চাকরি নির্ঘাত যাবে।
ভাগ্য ভাল যে লোকটার জুতোয় খুব নরম রবার লাগানো। লাথিটা তাই তুলোর বস্তার মতো লেগেছে। অবশ্য তাই যথেষ্ট। তবু একটা-দুটো ঝাকি মেরে সমীরণ কাত হল এবং হাতে পায়ে ভর দিয়ে চতুষ্পদের মতো উঠে তাকাল চারপাশে।
প্রচণ্ড গোলমালে পুলিশ! পুলিশ!’ বলে কারা যেন চেঁচাচ্ছে। সমীরণ দেখতে পায়, কাচের কাউন্টারের ওপাশে ক্যাশের লোকটা টাকার বান্ডিলের ওপর বুক দিয়ে পড়ে আছে গুলি-খাওয়া মানুষের মতো। আর কাউন্টারের দিকে পিছন ফিরে বুকে অন্তত বিশ হাজার টাকার নানান মাপের বান্ডিল অবহেলায় হাত দিয়ে চেপে রেখে ভারী অবাক হয়ে চেয়ে আছে মন্দা।
মন্দাকে চেয়ে থাকতে দেখেই একটা ঝাকি লাগল সমীরণের শরীরে। চাকরি! সে বডিগার্ড সিকিউরিটি অফিসার আর সেই কঁকিতেই সে সটান দাঁড়িয়ে পড়ে।
লোকটা মন্দার সামনেই দাঁড়ানো। গায়ের ধুলোময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে ইংরিজিতে গালমন্দ করছে। খুব কূটচোখে তার দিকে চায় সমীরণ। হ্যাঁ, আর একটা লাফ, কোমর পেঁচিয়ে আর একটা বলটান মেরে আবার পেড়ে ফেলতে হবে। মন্দা দেখছে। কাজ দেখানোর এই হচ্ছে সময়।
কিন্তু লাফ দেওয়ার আগেই এবার মন্দা এগিয়ে এসে তার হাত ধরে বলল, লাগেনি তো আপনার?
একগাল হাসে সমীরণ, বলে, নাঃ–আর বলতে গিয়েই টের পায়, তার ঠোঁট কেটে দু’ ফালা হয়ে গেছে লাথির চোটে। কলের মতো রক্ত পড়ছে নাক দিয়ে। জামা ভেসে যাচ্ছে রক্তে।
মন্দা বলল, ইস! পরমুহূর্তেই লোকটার দিকে ফিরে বলল, দ্যাট উইল টিচ ইউ এ লেসন।
লোকটা তোম্বা মুখে গাড়লের মতো হেসে বলে, হু ইজ দা গায়?
মন্দা শ্বাস ফেলে বলে, আমাদের সিকিউরিটি অফিসার। কিন্তু তোমার আক্কেলটা কী বলো তো? তোমাকে বলেছিলাম কিনা যে তিন সপ্তাহের আগে আমি কোনও জাহাজ-ফেরত লোকের সঙ্গে দেখা করি না।
লোকটা মন্দার কথার জবাব দেয় না, এগিয়ে এসে টপ করে সমীরণের হাতটা ধরে বলে, স্যরি। এক্সট্রিমলি স্যরি। আমার দোষ আমি কোনও ওয়ার্নিং দিইনি। জানতাম না তো যে মন্দার সঙ্গে আজকাল স্ট্রং ম্যান থাকে।
স্ট্রং ম্যান! কথাটা নোট করে রাখার মতো। মন্দা শুনেছে কী? একপলক মন্দাকে দেখে নেয়। সমীরণ। মন্দা দেখছে। কিন্তু কী দেখছে? তার ফাটা হাঁ হয়ে যাওয়া ঠোঁট আর চোট-খাওয়া নাক থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। একটু ভয়ও হচ্ছে আবার সমীরণের। এ লোকটা মন্দার বন্ধু, একে প্যাচ কষাটা কি ঠিক হল? মন্দা কিছু মনে করেনি তো?
সে লোকটার হাত ধরে কী বলতে হবে ভেবে না পেয়ে বলল, না, না, কিছু হয়নি। কিছু মনে করবেন না।