মন্দা ফোন রাখল। মুখ তুলে বলল, একটু আমার সঙ্গে চলুন।
সমীরণ খাজুরে আলাপ করে মেঘটা কাটিয়ে দেওয়ার জন্য একগাল হেসে বলল, ব্যাঙ্কে তো?
হু। একটু অ্যালার্ট থাকবেন। আজকাল ভীষণ চুরি ডাকাতি ছিনতাই হচ্ছে…
আহা, হোক। এসব যতদিন আছে ততদিনই তার চাকরি আছে।
.
রায়বাবুর গা শুঁকে শুঁকে চলা সমীরণের অভ্যাস আছে। রায়বাবুর নিয়ম, গায়ে শ্বাস ফেলতে হবে, শাসের শব্দ শোনা যাবে। তবে বোঝা যাবে যে পাহারাদার কাছেই আছে। রায়বাবুর গায়ের গন্ধ যে খুব ভাল তা বলা যায় না। তবে কিনা চাকরি ইজ চাকরি। গা শুকতে বলেছে তো তা-ই সই।
আজ কিন্তু চাকরির সঙ্গে দারুণ সুগন্ধও জুটে গেল। মন্দার গায়ের গন্ধ যে এত ভাল কে জানত?
নিয়মমাফিক সমীরণ মন্দার ঘাড়ে হুমড়ি খেয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে চলতে থাকে। আর এই করতে গিয়ে সে বিদেশি পারফিউম, দামি পাউডার, দুর্দান্ত শ্যাম্পু, এ সবের গন্ধ পায়। সে এমন সুন্দর গন্ধ যে নাক দিয়ে সোজা তার পেটে চলে যেতে থাকে। পেটটায় একটা খাওয়ার অনুভূতি হতে থাকে।
ফজলু যে বলে কথাটা তেমন মিথ্যে নয়। বাস্তবিকই চারদিকের বায়ুস্তরে এরকম নানা খাদ্যই রয়েছে। যদি শুষে নেওয়া সম্ভব হয় তবে আর আলাদা করে খাওয়ার দরকারই হয় না। পারবে কি ফজলু? যদি পারে তবে পৃথিবীর লাখো কোটি লোকের জন্য সেটাই হবে চূড়ান্ত বিপ্লব। খাওয়ারই যদি দরকার না হয় তবে বেকারি, ছাঁটাই, লে-অফ, ক্লোজারের পরোয়া করে কে?
ব্যাঙ্কের সামনে এসে মন্দা গাড়ি থেকে নেমে দরজা লক করল। সমীরণ রাস্তায় নেমেই চারদিকটা তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করে নিল। সবকিছুই সন্দেহজনক। উল্টোদিকের ফুটপাথে একপাল ভিখিরি বসে আছে, তাদের মধ্যে দু’জন ছোকরা, কী মতলব কে জানে! একটা ট্যাক্সি মন্দার গাড়ির পিছু পিছু এসে থামল, ভিতরে একজন ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওলা প্যাসেঞ্জার। ট্যাক্সিটা থামল বটে, কিন্তু লোকটা নামল না, বসে বসে একটা খবরের কাগজ খুলে পড়তে লাগল। কী মতলব কে বলবে? এইরকম চারদিকে হরেক সন্দেহজনক গতিবিধি, আচার-আচরণ। রায়বাবু কি সাধে তাকে গা শুঁকে থাকতে বলে?
রায়বাবুর চেয়ে অবশ্য মন্দার গা শোকা অনেক বেশি আনন্দজনক ব্যাপার। আজ সকালে দুধ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পেটটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। মন্দার গায়ের গন্ধ যেন পেটে সেই দুধের জায়গাটা ভরাট করে দিচ্ছে। ফজলুটা তো মিছে বলেনি!
ব্যাঙ্কের দরজায় উঠতে উঠতে মন্দা একটু বিরক্ত হয়ে পিছু ফিরে বলল, একটু সরে হাঁটুন তো! লোকের শ্বাস গায়ে লাগলে আমি ভীষণ অস্বস্তি বোধ করি।
লজ্জা পেয়ে, সমীরণ একটু পিছিয়ে যায়। গন্ধটার লোভে একটু বেশিই কাছে ঘেঁষছিল সে।
পিছিয়ে গিয়েও সে অবশ্য তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয় না। চারদিকে তীক্ষ্ণ চোখ রাখে। সন্দেহজনক নড়াচড়া লক্ষ করে। কাজ দেখাতে হবে। যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। নিজেকে সে রায় আচার্যির সিকিউরিটি অফিসার বলে জানে। লোককে বলেও তাই। বিভাস তাকে শিখিয়েছিল, লোকে জিজ্ঞেস করলে বলবি, আমি মিস্টার রায়ের এ ডি কং। কিন্তু অতটা বলতে সাহস পায় না সমীরণ।
টোকেন নিয়ে মন্দা আলতো হাতে নিজের চুল ঠিকঠাক করছে, সুন্দর বিভঙ্গে দাঁড়িয়ে রাজহাঁসের মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে চারদিক দেখছে। খুব অলস বিশ্রামের ভঙ্গিতে কয়েক পা হেঁটে গিয়ে দেয়ালের গায়ে ব্যাঙ্কের ঋণপ্রকল্প সংক্রান্ত একটা পোস্টার আনমনে দেখতে লাগল।
কিন্তু সমীরণ অতটা নিশ্চিন্ত হতে পারে না। চোখের কোণ দিয়ে সে দেখতে পেল, ব্যাঙ্কের সদর দরজার একপাশ দিয়ে খুব আবছাভাবে দাঁড়িয়ে একবার ভিতরে উকি দিল সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওলা ছোকরাটা। দুধসাদা জামা আর প্যান্ট পরা। চোখে একটা হালকা নীল রঙের পরকলা পরে নিয়েছে কখন। খুব নজর রাখে সমীরণ। রায়বাবু বলেন, তেমন কিছু দেখলে লাফিয়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলটান মেরে পেড়ে ফেলবে। সমীরণের পাচটা রপ্ত আছে, তবে কোনও মানুষের ওপর এখনও ফলায়নি।
মন্দার টোকেন নাম্বার ডাকা হল। মন্দা এগিয়ে গেল। কাউন্টারের ভিতর হাত বাড়িয়ে বান্ডিল বান্ডিল টাকা বের করে আনছে সে।
আর তখন সমীরণ বিস্ময়ে হাঁ করে দেখে, আশ্চর্য সাহসী সেই ফ্রেঞ্চকাট বেড়ালের মতো পায়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। বেশ মজবুত বিশাল চেহারা শার্টের খোলা বুক দিয়ে গলায় একটা সোনার চেন দেখা যায়, হাতে ঢিলা করে বাঁধা ঘড়ি কেতরে আছে, আর মুখে একটু হাসি। লোকটার হাতে আপাতদৃষ্টিতে কোনও অস্ত্র নেই বটে, কিন্তু পাকানো খবরের কাগজটা বাঁ হাতে বাগিয়ে ধরা। অসম্ভব নয় যে, ওই খবরের কাগজের ভিতরেই দোলা ছুরি বা নল রয়েছে।
বহুকাল ধরে এরকম একটা পরিস্থিতির জন্যই অপেক্ষা করছে সমীরণ। আজ পর্যন্ত সে কাজ দেখানোর তেমন সুযোগ পায়নি। বুকটা খুব দুরদুর করছে, উত্তেজনায় শরীরে ঝিমঝিম শব্দ হচ্ছে, ভয়ও লাগছে খুব, আবার সুযোেগ সামনে দেখে আনন্দও হচ্ছে খুব।
রায়বাবুর নিয়মমতো এ সময়ে সে পিছন থেকে মন্দার পিঠে আঙুলের খোঁচা দিল। আজকাল মেয়েরা যে সব ব্লাউজ পরে তাতে গোটা পিঠে বুকে ব্লাউজের ন্যাকড়াটুকু খুঁজে পাওয়াই দায়। তাই সমীরণের খোঁচাটা সোজা মন্দার মেরুদণ্ডের নীচ বরাবর হাড়ে মাংসে লাগল।