তাই তো! সমীরণ ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবে। দ্বিধায় পড়ে যায়।
ফজলু রোগা মুখে চওড়া হেসে বলে, এই যে সকালবেলা সুমুন্দির পোয়েরা গলায় মালা পরিয়ে গেছে বলির পাঁঠার গলায় যেমন পরায়, এই মালা কি কোনও খাবার জিনিস, বললা! তবু হল কী জানো? যেই আমার গলায় মালা দিল সেই তক্ষুনি যেন ফুলের গন্ধে আমার শরীরের ভিতরটায় লালা ঝরতে লাগল। আমার গলা, কণ্ঠা জিভ ভিজে গেল। পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, মালা থেকে আমার শরীরটা গন্ধ টেনে নিচ্ছে। সারা সকাল ধরে মালাটাকে শুষে এই দেখো এখন একেবারে তুলসী কাঠির মতো শুকিয়ে এসেছে ফুলগুলো।
ফুলগুলো শুকিয়েছে ঠিকই, সমীরণ হাত বুলিয়ে দেখে, তার শরীরটা এক অদ্ভুত অনুভূতিতে শির শির করতে থাকে। সে বলে, বলিস কী?
চোখের দিব্যি।
অবিশ্বাসই বা করে কী করে সমীরণ? তার নিজেরও যে অনেকটা ওইরকমই হয়। ভাল, সুন্দর, পছন্দসই কিছু দেখলে বা শুনলে তার চোখ, কান, গায়ের চামড়া যেন তা গিলে খেয়ে নিতে থাকে। বাস্তবিকই তার পেটের মধ্যেই চলে যায় গোটা ব্যাপারটা। ঠিক খাওয়ার অনুভূতি হয়। সমীরণ তাই খুব বেশি অবিশ্বাস করতে পারে না। তবু সন্দেহবশে বলে, পারবি?
মানুষ কী না পারে বলো! তারাপীঠের কোন এক সাধু নিজের হাগা খেত, বৃত্তান্তটা শশানোনি! ভাবলাম, হয় সেটা ভগবানের মহিমা, নয়তো গাঁজাখুরি। কিন্তু নিজের চোখে যে দৃশ্য দেখলাম কদিন আগে, জানলে? উলটোদিকের ফুটপাথে একটা পাগল বসে থাকে প্রায়ই। হাফ প্যান্ট পরা, খালি গা, বসে বসে একটু একটু হাসে আর আপনমনে বসে বসেই বাহ্যে পেচ্ছাপ করে দেয়। এই কদিন আগে কী দেখলাম জানো? খাচ্ছে।
খাচ্ছে?
মাইরি! চোখের দিব্যি। নিজের মল।
ওয়াক।
ঘেন্না পেয়ো না। কথাটা হচ্ছে, লোকে না পারে কী?
গা বমিবমি করায় সমীরণ উঠে পড়ে। বলে, সাড়ে দশটা বাজতে যায় বুঝি রে। চলি।
আবার এসো।বলে ফজলু হাঁটু থেকে হাতের বাঁধন খুলতেই আপনা থেকে তার শরীরটা ন্যাকড়ার মতো নেতিয়ে পড়ে গেল চৌকিতে।
রায়বাবুর বেশ কয়েকটা কারখানা আছে, তাছাড়া চার-পাঁচরকমের ঠিকাদারির কাজে বিস্তর কুলিও খাটে। কারখানার পেমেন্টের দিন বা কুলিদের হপ্তা দেওয়ার সময়ে রায়বাবু যখন ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে যান তখন সমীরণকে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। রায়বাবুর কড়া নির্দেশ আছে, সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু গা খুঁকে শুকে থাকবে। তোমার নিশ্বেসের শব্দ যেন শুনতে পাই, আমার গায়ে যেন তোমার শ্বাস টের পাই, চারদিকে খুব নজর করবে। যদি দেখো কেউ সন্দেহজনকভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে বা আশেপাশে ঘুরঘুর করছে তো আমাকে আঙুলের খোঁচা দিয়ে জানান দেবে। আর যদি দেখো কেপমারির দল বা ডাকাত বদমাশ গোছের কেউ কাছে ভিড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলটান দিয়ে পেড়ে ফেলবে।
কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে সমীরণ। রায়বাবু ব্যাঙ্কে যান, টাকা তোলেন, গোনেন, ব্যাগে ভরেন, বেরিয়ে আসেন, সমীরণও রায়বাবুর পিঠের ওপর হুমড়ি খেয়ে চলে, বড় বড় শ্বাস ফেলে রায়বাবুর ঘাড়ে, চারদিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে দেখে। অবশ্য তখনও লাফিয়ে কারও কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলটান দিয়ে পেড়ে ফেলার দরকার হয়নি। তবে দরকার হতে পারে ভেবে প্রতিদিন রাতে শোওয়ার সময় এবং ঘুম থেকে উঠে সকালবেলায় বিছানায় পাচটা অভ্যাস করে সমীরণ। মানুষের অভাবে বালিশটাকে বিছানার মাঝখানে একটু থুবড়ে দাড় করিয়ে নানাভাবে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে লাফিয়ে ডাইভ খেয়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলটান মেরে বালিশটাকে পেড়ে ফেলে সে। অভ্যাসটা রাখা ভাল। কারণ, চারদিকে এত চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই যে যে-কোনওদিন প্যাচটা দরকার হতে পারে।
রায়বাবু নেই, তার বদলে মন্দা আজকাল ক’দিন হল কাজকর্ম দেখছে। ভালই দেখে। তবে সমীরণ আজকাল মন্দার সামনে কিছু ভয়ে ভয়ে থাকে। সেদিন তাকে অফিসে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল মন্দা। সে থাকেনি। পরে তাকে সুখন পুরো ব্যাপারটা বলে সাবধান করে দেয়, সমীবাবু, আপনার আমার দু’জনেরই নোকরি না চলিয়ে যায়। মন্দা অবশ্য তাকে কিছু বলেনি আজ অবধি, তবু বড় ভয়ে ভয়ে থাকে সমীরণ।
বাইরের ঘরটায় সন্তর্পণে বসে সমীরণ অপেক্ষা করছিল। রায়বাবু চেম্বারে মন্দা। দরজা বন্ধ। সেদিকটায় একবার চেয়ে আপনমনে দাত দিয়ে নখ খোটে সমীরণ। খুব বেশি কিছু করার নেই।
সমীরণের মনটা বড় খারাপ। ফজলুটা দশদিন ধরে নাগাড়ে না খেয়ে আছে। বাঁচবে তো! নিত্যপদ মুড়ির ফেরত পয়সাটা দেয়নি। কেরোসিনের বিশ পয়সা মেরেছে ওর বাপটা। তার ওপর হরিণঘাটার একবোতল স্ট্যান্ডার্ড দুধ নষ্ট হয়ে গেল, সেটা ফেরত দিতে দিয়েছিল বুড়োটাকে। বুড়ো এখন বলে কিনা, নষ্ট দুধটা বেড়ালে খেয়েছে। বেড়াল নয় নিজেরাই খেয়েছে। সমীরণ জানে। মনটা বড় বিদিকিচ্ছিরি রকমের হয়ে যায় এসব ছ্যাচড়ামির কথা মনে হল। এক বোতল দুধ উশুল হল না, পয়মাল গেল।
এই সবই ঝুঁদ হয়ে ভাবছিল সমীরণ। এমন সময় টিং টিং করে বেল বাজল। তার ডাক।
চেম্বারের দরজা খুলে ভিতরের ঠান্ডায় ঢুকে দাঁড়িয়ে সমীরণ দেখল, মন্দার কানে আজও ফোন। মন্দা কাকে যেন বলছে, না, আমার সঙ্গে তোমার কোনও কথা থাকতে পারে না…শোননা, একটা লম্বা পাড়ি দিয়ে সেইলাররা যখন ডাঙায় নামে তখন তারা মেয়েদের পক্ষে মোটেই নিরাপদ নয়…আমি জানি যে তুমি সাধারণ সেইলার নও, ম্যারিন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু আমার কাছে অল আর দি সেম…না না, আমি বলে দিচ্ছি রজত, আগামী তিন সপ্তাহ আমার সঙ্গে দেখা করবে না…আমার অনেক কাজ তবু..হঁা…না, আই অ্যাম লুকিং আফটার দি বিজনেস। এক্ষুনি ব্যাঙ্কে বেরোব..আজ পে ডে। দেখা হবে, কিন্তু এখন নয়… না, না প্লিজ…