ফজলুর হাতের চেটোটা বড্ড ঠান্ডা। সাদা। সমীরণ এক হাত দিয়ে হাত ধরল। অন্য হাতে ফজলুর মাথার নীচে ধরে যত্নে ঠেলে তুলল। ফজলু বসতেই দেখা গেল, তার গলায় একটা রজনীগন্ধার মালা। বসে থাকতেও ফজলুর বুঝি কষ্ট হয়। সমীরণ বলে, আমার গায়ে ঠেস দিয়ে বোস। কাধে মাথাটা রাখ।
ফজলু ক্ষীণ হেসে বলে, না। পারব। অনশন তো সবে শুরু। আরও কতদিন চলবে কে জানে? মলয়বাবু দিল্লি পালিয়েছে।
তা হলে কী হবে?
ফজলু মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে হিক্কার মতো শব্দ করে বলে, পালাবে কোথায়? এই বাড়িটাই যে ওর অফিস। একদিন না একদিন আসতেই হবে।
যদি দু’মাস পরে ফেরে?
তাও ফিরবে তো!
ততদিন কি বাঁচবি ফজলু, না খেয়ে? কেমন বুঝছিস এখন শরীরটা? কেমন লাগছে?
ফজলুর গোলগাল মুখটা এখন লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে। মুখের হাড়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। চামড়ায়। সেই মুখে একটু হেসে বলল, বিড়ি আছে সমীদা?
দাঁড়া, আনছি।—এই বলে সমীরণ তাড়াতাড়ি গিয়ে এক বান্ডিল বাড়ি আর দেশলাই কিনে আনল। এই একটা জিনিস ফজলু খাচ্ছে। ধোঁয়ায় কোনও পুষ্টি আছে কি না কে জানে, তবু যা হোক পেটে তো যায়।
ফজল বিড়ি দাতে চেপে ধরে বটে কিন্তু দেশলাই ঠকতে পারে না। যতবার বারুদে কাঠি মারে ততবার হাত এদিক ওদিক হয়ে যায়। কাঠিতে বাক্সে ঘষটা লাগে না।
সমীরণ বিড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, মরবি যে এরকম করে!
ফজলু খুব মন দিয়ে বিড়ি টানতে টানতে পিছন দিকে চেয়ে লাশের মতো পড়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখে চোখ ঘুরিয়ে বলে, বড় একঘেয়ে লাগে। তাছাড়া আমার আর কষ্ট তেমন কিছু নেই।
বাজে বকিস না, শুকিয়ে চারভাগের একভাগ হয়ে গেছিস।
তবু আমার অবস্থা অনেক ভাল। বসতে পারছি, কথাটথা বলছি। ওদের বেশিরভাগই কাল থেকে উঠছে না। আজ খবরের কাগজে ছোট করে আমাদের খবর দিয়েছে, জানো? সকালবেলা মেলা লোজন আমাদের দেখতে এসেছিল, ফুলের মালাটা অনেক দিয়ে গেছে। একজন খবরের কাগজ খুলে খবরটা দেখাল। কিন্তু চোখে সবাই এমন ধাঁধা দেখছি যে পড়তে পারলুম না, তখন সেই লোকটা পড়ে শোনাল। কিন্তু একটুও আনন্দ হল না, বুঝলে! অফিস টাইমের পর বিকেলেও আবার অনেক লোক আসবে, বক্তৃতা দেবে, মালা দেবে। কিন্তু আমরা আজকাল কানে শুনতে পাই না তেমন, ভো ভো করে। গলা বাড়িয়ে মালাটা নেওয়ার মতোও জোর নেই বেশির ভাগের। তাই শোয়া অবস্থাতেই মাথা তুলে মালা গলিয়ে দিয়ে যায়। আমি কিন্তু বসি, মালা নিই, খানিক বক্তৃতাও শুনি। না, সমীদা, আমি সে তুলনায় ভাল আছি।
সমীরণ ফজলুর পেটের খোঁদলে হাত রেখে দেখে। পেটটা কলকল শব্দ করে জানান দিল। সমীরণের দম ফোট লাগে। রুদ্ধ স্বরে বলে, মরবি যে!
ফজলু মাথা নেড়ে বলে, রমজানের মাসে রোজা রাখি। আমার অভ্যেস আছে, বলেছি না তোমায়? রোজার মাস আবার এসে গেল, না গো সমীদা?-বলে ফজলু বিড়ি ফেলে খুব দুরে চোখ মেলে বসে রইল কিছুক্ষণ।
সমীরণ ধীরে ধীরে বদ্ধ শ্বাস ছাড়ে। আর তার নাকে একটা বাঁশির মতো হয়।
ফজলু দুটো দুবলা হাতে হাঁটু দুটো জড়িয়ে বসেছে। হাঁটুর মাঝখানে ঝুনো নারকোলের মতো মুখ। খুব দূরের চোখে চেয়ে থাকে আনমনে বলল, আমার একটা মতলব আছে সমীদা, জানলে! যদি হাসিল হয় তবে একখানা কাণ্ডই হবে। লোকে সোনার মেডেল দিয়ে যাবে আমায়।
কী কাণ্ড?
মীরাবাজারে একবার একরাম আলি নামে এক ফকির এসেছিল, তোমার মনে নেই? তা সে ফকির বাবা ছিল নিখাগি। দিনের পর দিন অন্নজল ছাড়া দিব্যি বেঁচে ছিল। হাঁটত, চলত, কথা কইত, হাসতও। আমি দিনকতক তার পেছুতে ঘুরেছিলাম। তা সে তেমন পাত্তা দিত না আমায়। অনেক হাতে পায়ে ধরতে সে একদিন বলল, না খেয়ে থাকাটাও একটা অভ্যেস রে। তবে বড় কঠিন সাধনা। হয় কী জানিস? অনেকটা গাছের মতো ব’নে যেতে হয়। শেষে এমন হবে যে ভূঁয়ে দাঁড়িয়ে আছিস, তো সেই মাটি থেকে তোর পা চো করে খানিক রস টেনে নিল শরীরে। রোদুরে হাওয়ায় দাঁড়ালি, তো তোর হাত পা তাই থেকে খানিকটা ভিটামিন ক্যালসিয়াম টেনে নিল। এই করতে করতে আর তখন খাওয়ার দরকার হয় না। আল্লার কুদরতে প্রকৃতিই শরীরের নানা অন্ধিসন্ধি দিয়ে খাদ্য ভরে দেয়।
যাঃ।
মাইরি। বিশ্বাস করো। তা আমার মাথায় আজকাল সেই ফিকিরটা খুব খেলছে। যদি কায়দাটা পাই সমীদা, তবে সব শালাকে মজা দেখাব। যত আমার মতো হাভাতে আছে সবাইকে কায়দাটা শিখিয়ে দেব। চাই কি, শেখানোর জন্য একটা ইস্কুলও খুলতে পারি। সাইনবোর্ডে লিখে দেব, না খেয়ে বেঁচে থাকার কায়দা শিক্ষা করুন। লাখ লাখ শিখতে এসে জুটবে, দেখো।
না খেয়ে খেয়ে তোর মাথাটা গড়বড়ে হয়ে গেছে।
তর্ক করার মতো তাকত নেই ফজলুর। কিন্তু ঝুম হয়ে চোখ বুজে একটা তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকে সে। তারপর ক্ষীণ, শোনাসুরে বলে, আমার যেন একটু একটু করে ব্যাপারটা হচ্ছে, জানলে সমীদা। দুদিন যাবত টের পাচ্ছি, বাতাস থেকে আলো থেকে যেন মাঝে মাঝে আমার হাত, পা, গায়ের চামড়া চো করে খানিকটা কী যেন টেনে নিচ্ছে। মনে হয় এখন যদি একবার ভেজা মাঠঘাটে গিয়ে কিছু সময় দাঁড়াতে পারতাম তা হলে ঠিক আমার পা দুটো গাছের শিকড়ের মতো রস টানত কুঁদ হয়ে। মাটি থেকেই তো গাছপালা খেয়ে বাঁচে, সেই গাছপালা খেয়ে তাবত পশুপাখি তুমি আমি বেঁচে আছি। তবে মাটি থেকে সরাসরি খেতে পারব না কেন বললা!