কিছু বলার নেই তবু হরিদেব ব্যস্তসমস্ত হয়ে রওনা হতে হতেই বলে, আমার ছেলের বউভাত ছিল কিনা।
বউটি পিছন থেকে বলে, ওমা! সে তো কবে হয়ে গেছে শুনেছি। আর তার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক রে বাবা? না। বুড়োর মাথাটাই গেছে…
হন্তদন্ত হয়ে হরিদেব ইস্কুলবাগে যাচ্ছে, বাড়ির ফটকেই ধরদের বুড়ো গিন্নি ধরে ফেলল, হরি, ব্যাপারটা কী বলল তো শুনি! তোমার মেয়ে মলি বিনা নোটিশে আমার বাড়ির কাজ ছেড়ে দিল, বলে কিনা বেশি কাজ, ছুটি পাই না, সিনেমায় যেতে পারি না। ওদিকে দেখছি সরকারি কোয়ার্টারে এক ছোকরার বাসায় যথাসর্বস্ব করছে পনেরো টাকায়। কাল দেখেছি, রাত দশটার পর কোয়ার্টার থেকে বেরোচ্ছে। এইবেলা সময় পাচ্ছে? সিনেমা দেখতে পাচ্ছে?
হরিদেব তার কী জানে! সে মলির জন্মদাতা হতেও পারে, কিন্তু বাপ নয়। কটকটে কথাগুলো শুনতে শুনতেই হরিদেব হনহন করে হাঁটে। বলবেই লোকে। কত বলে।
ওই আবার মোড়ের মাথায় সমীরণবাবু। কেরোসিনের ফেরত পয়সা! ছেলের বউভাতের কথা আবার বলা ঠিক হবে কি না তা ভাবতে থাকে হরিদেব।
সমীরণবাবু তাকে ধরল বটে তবে কেরোসিনের ফেরত পয়সার কথা না তুলে গম্ভীর গলায় বলে, তোমার ছেলে নিত্যপদ কোথায়? গতকাল মুড়ি আনতে দিয়েছিলাম, কুড়িটা পয়সা ফেরত দেয়নি।
একগাল হেসে হরিদেব বলে, মহা চোর। চুপি চুপি গিয়ে আমার ঘরে ঢুকে যান। বসে বসে ছানা খাচ্ছে। হুটোপাটি করে যান, নইলে পালাবে।
সমীরণ চোটেপাটে বাড়ির দিকে ধেয়ে যায়। খুব হাসে হরিদেব। নেত্যটা আজ ঝাড় খাবে।
খুকিটা ফাঁকা স্কুলের ফটকে দাঁড়িয়ে সত্যিই কাঁদছিল। একেবারে গুয়ের গ্যাংলা একরত্তি মেয়ে। হরিদেব গিয়ে তাকে সাপটে ধরে হাত থেকে টিনের বই বাক্স আর কাঁধের জলের বোতল নিজের হাতে নিয়ে একগাল হেসে বলে, কেঁদো না খুকি, বড় ভুলে যাই যে! বুড়ো হয়েছি তো।
খুকিটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে হাত ধরে হাঁটে। বড় কষ্ট হয় হরির।
ঝিলের ধারে মুখোমুখি নেত্যর মায়ের সঙ্গে দেখা। দেখে ভারী আনন্দ হয় হরিদেবের। ছোটলোকের মতো নয় মোটেই তার বউ। পরিষ্কার গা হাত, ফরসা একটা ছাপা শাড়ি পরা, পায়ে স্যান্ডেল। বালিগঞ্জে বড়লোকের বাড়িতে কাজ করে। ষাট-সত্তর টাকা মাইনে, বছরে দু-তিন জোড়া শাড়ি ব্লাউজ, এর ওপর পার্বণী পায়। ভাল অবস্থা যাকে বলে। মাঝবয়সি ভদ্রমহিলার মতো বউকে দেখে ভারী গর্ব হয়!
বিনা ভূমিকায় নেত্যর মা বলল, ছেলের তৃতীয় পক্ষের বউ দেখেছ তো!
দেখেছি।
ও বাড়ি আর যেয়ো না। ঝেটিয়ে খ্যাদাবে। এই আমি ও বাড়ি থেকে আসছি। পদটার কাল থেকে শরীর খারাপ, নাগাড়ে বমি করছে। বউ দেখো গে যাও ফুল-ফুল সেজে বাজারে বেরোল। আমাকে দেখে বলল কী জানো?
খুব যেন মজার ঘটনা এমনি ভাব দেখিয়ে চোখ বড় করে হরিদেব বলে, কী?
বলল, যখন তখন হুটহাট কী দেখতে আসসা বলল তো! সংসার-ভাঙানো ডাইনি কোথাকার! আমি সকলের জন্য যখন তখন রাঁধতে পারব না। আরও কত কথা! শেষে বলে কী, ভালমানুষের মেয়ে হয়ে থাকো তো ছেলের বমি পরিষ্কার করে দিয়ে যাও মুরোদ দেখি, নইলে গোয়েন্দাগিরি করতে আসবে তো ঝ্যাঁটা।
বলল?—খুব অবাক ভাব দেখায় হরিদেব।
নেত্যর মা ‘হরি’ কথাটা মুখে আনে না, তাই বড় ছেলেকে বরাবর ‘পদ’ বলে ডাকে। বলল, পদটার ঘরে গিয়ে দেখি চার জায়গায় বমি থুপ হয়ে মাছি ভ্যান ভ্যান করছে। সেই রাত থেকে। কেউ পরিষ্কার করেনি। দেখে গা এমন বিড়িয়ে উঠল যে নাকে কাপড় চেপে পালিয়ে বাঁচি না।
ভারী আমুদে হাসি হেসে হরিদেব বলে, খুব তাড়ি টেনেছিল। আমি কাল সন্ধেয় দেখেছি বাজারের রাস্তায় উবু হয়ে বসে তাড়িওলার সঙ্গে খুব জমিয়ে খাচ্ছে। আমাকে ডেকেছিল।
গম্ভীর হয়ে বউ বলে, ও বাড়ি আর যেয়ো না। না খেয়ে থাকো সেও ভাল।
তা ঠিক। তবে কাল দুপুরে হরির বউটা ভাজা মুগের ডালটা যা বেঁধেছিল, চার-চারটে রুটি খেয়ে নিলাম। কাঁচা লঙ্কার এমন বাস ছেড়েছিল কী বলব।
মরণ! তুমি কি মানুষ?
না।
আপনমনেই মাথা নাড়ে হরিদেব। এ কথাটা সে মানে। হুবহু মানুষ নয় সে। কোথায় কী যেন গলতি আছে একটু। বউয়ের দিকে খুব গর্বের চোখে চেয়ে সে হাসে।
গা বিড়োনো চাপতে নেত্যর মা জর্দা দিয়ে পান খেয়েছে। মুখ থেকে সুন্দর গন্ধ আসছিল। গা থেকেও। বাতাসটা শোকে হরিদেব।
নেত্যর মা বলে, আমি যাচ্ছি। পদকে দেখলে বোলো, আমি আর আসছি না।
আচ্ছা।
তুমিও যেয়ো না।
আচ্ছা।
নেত্যর মা উলটোবাগে চলে গেল। বারবার পিছু ফিরে সেদিকে দেখল হরিদেব। তারপর খুব অহংকারের হাসি হেসে খুকিকে নিচু হয়ে কানে কানে বলল, দেখলে তো খুকি, এই হল আমার বউ। বুঝলে! আমার বউ। আর আমার ছেলের বউ ভারী ভাল। মুগের ডাল রাঁধে, জানলে খুকি?
.
পোস্টারে লেখা, অনশনের আজ দশদিন।
দেখে হাঁ করে থাকে সমীরণ। দশদিন!
চৌকির ওপর সারি সারি রোগা শরীর পড়ে আছে। নড়ছেও না। বেশ মিষ্টি ফুলের সুবাস পাওয়া যাচ্ছে ত্রিপলের ঘরটায়।
সমীরণ ফিসফিস করে ডাকে, ফজলু! এই ফজলু!
খুব ক্ষীণ নাকিসুরে জবাব আসে, কে? মলয়বাবু?
না। আমি সমীদা!
ফজলু পাশ ফিরে আস্তে আস্তে চোখের পাতা খোলে। একটা হাত অতি কষ্টে বাড়িয়ে ধরে বলে, একটু তুলবে আমায় সমীদা?
পারবি বসতে?
পারব। আস্তে তুলো। ঝট করে বসলে মাথায় পাক মারে।