বৌধায়ন জানে সে যে অপদার্থ তার কারণ একটাই। সে কখনও কারও প্রতি নিষ্ঠুর হতে পারে না। কোনওদিনই সে কাউকে মারেনি, গাল দেয়নি তেমন করে। যদি বা দিয়েছে তারপর থেকেই গেছে তার মনের শান্তি, চোখের ঘুম। নিজের বা আর কারও রূঢ়তা সে একদম সহ্য করতে পারে না। কাউকে অপমান করে না সে ভয়ে। করলে সে নিজে কষ্ট পায় সব থেকে বেশি। ঠেলাওয়ালাটার মুখ তার চোখের সামনে হুবহু ভেসে উঠছে বারবার, সুখনের শুকনো গলার কথা শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট। সেইসব স্মৃতি বিষ-বিছের মতো কামড়ায় তাকে এই নিশুত রাতে।
বড় হতাশায় উঠে পেচ্ছাপ করে বৌধায়ন। আবার ঘর ভাসে। ঘেন্নায় সে খাটে উঠে শোয়। পায়ের ব্যথা বাড়ে। পৃথিবীতে মানুষ জন্মের মতো খারাপ কিছু সে আর ভেবে পায় না। ভীষণ জটিল এই জীবন, কুটিলতায় ভরা। কত সরল, সুন্দর জীবন গাছের!
যারা তাকে চেনে তারা সবাই টের পেয়ে গেছে, সে কী ভীষণ অপদার্থ অকর্মণ্য। এমনকী মেজবউদি জয়তী যে ওই বিপজ্জনক ব্যাপারটায় তার সঙ্গে গিয়েছিল তার মানেও পরিষ্কার। মেজবউদি জেনে গেছে, বৌধায়নকে দিয়ে কোনও কিছু হবে না। মেয়ে হয়েও কাপুরুষ দেওরের সঙ্গে গিয়েছিল তাই।
একা ঘরে নিজের উদ্দেশে ছিঃ ছিঃ করে ওঠে বৌধায়ন। না, সে এখনকার পৃথিবীর উপযুক্ত নয়।
.
০৭.
সকালের দিকেই নিত্যপদ এসে খুব উত্তেজিতভাবে বলে, সব বাড়ির দুধ ছানা হয়ে গেছে বাবা!
হরিদেব সেটা ভাল করে জানে। তবু চোখ বড় করে ফোকলা মুখে হেসে বলে, বলিস কী?
সাত-সাতটা বাড়ি ঘুরে এলুম। যারাই বোতলের দুধ উনুনে চড়াচ্ছে তাদেরটাই ভোকাট্টা হয়ে ছানা ছেড়ে দিচ্ছে।
তো কী হবে?-বলে হরিদেব ছেলের দিকে চেয়ে থাকে।
নিত্যপদ মোড়লের মতো বলে, কিচ্ছু হবে না বাবা। ছানাটা বোতলে ভরে কাল সকালে ডিপোতে ফেরত দিলে ডিপোর দিদিমণিরা কার্ডে লিখে দেবে। নষ্ট দুধের বদলে আবার দুধ দেবে।
বটে?-বলে খুব আমোদে হাসে হরিদেব।
এত এত ছানা!–বলে নিত্যপদ হাতের খাবলা দেখায়।
গদাধরবাবু যে ঘরটায় তাকে থাকতে দিয়েছে তার দরজার পাল্লা নেই, জানলা হা-হা করছে। তবে এ ঘরে একটা পুরনো চৌকি আছে, তাতে হরিদেব খুব আরামে শোয় বসে। এখন চৌকির নীচে উবু হয়ে একটা চটের ব্যাগ টেনে এনে সে চার-চারটে বোতল বের করে।
আই বাস!— নিত্যপদ বলে।
হরিদেব ভারী টুলটুলে হাসি হেসে বলে, গদাইবাবুদের দু’ বোতল আর দুই ভাড়াটের দু’ বোতল। ফেরত দিতে দিয়েছে আমাকে। অনেক ছানা। খাবি?
চোখ বড় করে নিত্যপদ বলে, খাব কী? ফেরত দেবে না?
সে কথায় কান দেয় না হরিদেব, বিড়বিড় করে বলে, কাল পর্যন্ত টকে গিয়ে গন্ধ ছাড়বে। জিনিসটা নষ্ট হয়ে যাবে।
বাবুরা ধরবে যে তোমাকে!
হরিদেবকে সবাই ধরে। ঘরে, বাইরে, রাস্তায় হরবখত লোকে তাকে পাকড়াও করে বলে, এটা আনোনি, সেটা দাওনি, অমুক করেছ তমুক হারিয়েছ।
তা লন্ড্রির বিল হারিয়ে ফেলে হরিদেব, জিনিস আনলে ফেরত পয়সার গড়বড় হয়, তেজপাতার বদলে শুকনো লঙ্কা কিনে এনে দেয় লোককে। লোকের কথাতে আর তেমন গা করে না সে। ছেলেকে বলল, খাই আয় দুজনে।
এবার নিত্যপদ খুশি হয়ে বলল, মাইরি বাবা, খাবে!
হরিদেবের আনন্দ ধরে না। একটা কলাইয়ের বাটি বের করে দুটো বোতলের নষ্ট দুধ ঢালে তাতে। পিছল পিছল কটু গন্ধের হড়কানো সাদা কাথের মতো ড্যালা আর জল ঝরে পড়ে। বাটিটা চৌকির মাঝখানে রেখে দু’ধারে বসে বাপ আর ছেলে খায়! খেতে খেতে নিত্যপদ বলে, একটু গুড় বা চিনি হলে বাবা? অ্যাঁ!
এমনিও ভাল। খা।
কাল কী করবে? ছানা ফেরত না দিলে দিদিমণিরা লিখে দেবে না, তখন?
সমীরণবাবু কিছু বলবে না, ধর বউদি একটু খিটমিট করবে। গদাইবাবুদের দুটো বোতল ফেরত দেব।
দিয়ো। নইলে তোমাকে এ বাড়ি থেকে গড়িয়ে দেবে। দিলে যাবে কোথায়? নতুন বউদিটা যা খচ্চর না!
খুব খচ্চর?
মা বলে ঢ্যামনা মাগি।
হরিদেবের ছানার মুখ খুব হাসে। পা তুলে উবু হয়ে বসে বাটি ধরে ছানার জলটা চুমুক মেরে খানিক খেয়ে নিত্যপদর হাতে বাটি দিয়ে বলে, খা।
বাটি শেষ করে নামিয়ে রেখে নিত্যপদ বলে, সমীরণবাবুর ক্রাচিনের পয়সা ফেরত দিয়েছ?
কেরোসিনের পয়সা? ও! সে কথা হয়ে গেছে। বলেছে দিতে হবে না।
কবে বলেছে?
কাল পর কবে যেন!
নিত্যপদ সন্দেহের চোখে চেয়ে বলে, কাল বিকেলেও আমাকে ধরেছিল মোড়ে। বলল, তোর বাবা কোথায়?
হরিদেব উদাস মুখে একটা বিড়ি ধরায়। সবাই ধরে তাকে। নতুন নয়।
গদাধরবাবুর বাড়ির নীচতলাটা পিজরাপোল। ছারপোকার মতো ভাড়াটেরা গিজগিজ করছে। ঘরেরও অন্ত নেই। দিনরাত জল নিয়ে, এঁটো কাটা, উনুনের ধোঁয়া, এটা সেটা নিয়ে ক্যাচম্যাচ। সেই পিজরাপোল থেকে রোগা একটা বউ বেরিয়ে এসে খনখনে গলায় ডাকে, অ হরিদা! হরিদা!
নিত্যপদ কান খাড়া করে শুনে বলে, বাবা, বেলামাসি ডাকছে টুসিকে ইস্কুল থেকে আনতে যাওনি আজ!
ওই যা। ভুলে গেছি। ক’টা বাজে?
দশটা বেজে গেছে কখন! দেবেখন বেলামাসি, যাও।
হরিদেব মুখখানা গম্ভীর করে বেরিয়ে গিয়ে বলে, এই যাচ্ছি বউদি।
ভুলে যাও কী করে বলো তো! কচি মেয়েটা এখন আসে কী করে? এতক্ষণে কান্না জুড়েছে বোধহয়। মাসের শেষে পাঁচ-পাঁচটা টাকা নাও কি এমনি এমনি? মেয়েটাকে ইস্কুলে দিয়ে এলে সকালে আর আনতে ভুলে গেছ, মাথাটা খেয়েছ নাকি?