কই রে!—–হরিদেব ছেলেকে ভেঙিয়ে বলে, কাপড়ের তলায় লুকিয়ে আছি নাকি? কাকে বেচলাম সেইটেই তো মনে নেই। তা বলে কি চোর!
হরিদেব উদাস চোখে রাস্তা দেখে।
নিত্য ঠেলা দিয়ে বলে, টিভি দেখেছ বাবা? ঠিক সিনেমার মতে, না?
হু।
বিকেলের দিকে শহরতলির দোকানপাট একে একে খুলছে। চালপট্টির মুখে গরম তেলে আলুর চপ ছাড়ল গণশা। বেড়াতে বেড়াতে ছেলের পিছু পিছু চলে এসেছিল হরিদেব।
নিত্যটা চুরি শিখেছে। নইলে অত পয়সা পায় কোথায়? যেখানে সেখানে ঠেক খাচ্ছে আর জিনিস কিনছে।
নিত্য তিনটে চপ কিনে একটা বাপকে দিয়ে বলল, আর চাইবে না বলে দিচ্ছি!
আমি চাই? তুই তো দিলি!
নইলে তো নজর দেবে!
নিয়ে নে না। তুই খা।
নিত্যর একটু মায়া হয় বোধহয়। বলে, আচ্ছা খাও।
বাপটা খায়। কিন্তু ভেবে পায় না, সে আসলে কারটা খায়।
.
০২.
রায়বাবু আর আচার্যিবাবু কেউই কলকাতায় নেই। তারা দু’জন না থাকলে সমীরণের ছুটি। কিংবা ছুটিও ঠিক নয়। আসলে কথা হয়ে আছে, রোজ অফিস খুলে বসতে হবে। পার্টি এলে কথাবার্তা বলতে হবে। গোটা পাঁচেক পার্টিকে তাগাদা দিতে বেরোতে হবে। কিন্তু এসব হল কথার কথা। নজরদার না থাকলে দিনমান ভূতের মতো কে অন্ধকার অফিসঘরটায় বসে থাকে।
নজরদার অবশ্য একজন আছে। সে হল সুখন বেয়ারা। বেয়ারা কে বেয়ারা, অফিসঘরের বাইরে একটা খুদে উনুন জ্বেলে সে আবার পাঁচটা খুদে অফিসের বাবুদের চা দেয় বলে চা-ওয়ালাও বটে, আবার সকালে সে-ই ঝাড় লাগিয়ে জমাদারের কাজ করে বলে জমাদার কে জমাদার। তার আরও রোজগার আছে। রাতে ফাঁকা অফিসঘরগুলোয় সে তার দেশওয়ালি ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, কুলি-মজুরদের শোওয়ার ব্যবস্থা করে, মাথা পিছু প্রতি রাতে বিশ পঞ্চাশ পয়সা নেয়। প্রথম প্রথম সুখন সমীরণের ওপর খুব মেজাজ নিত। তারপর ক্রমে এখন সুর নরম হয়েছে। কিন্তু নজর সে রাখে ঠিকই। কবে সমীরণ এল, কবে এল না, এসব টুকে রাখছে। রায়বাবু আচার্ষিবাবু ফিরলেই লাগাবে।
তবে সমীরণের সুবিধে হল, তার চাকরিতে আউটডোর আছে। সিনেমার শুটিং-এর মতো। মাঝে মাঝে শহরে ভো চক্কর মারতে হয়। আজকাল ক’দিন সারাবেলা গড়িমসি করে কাটিয়ে বিকেলে অফিসে ফিরে সুখনকে বলে—আউটডোরে কাজ ছিল রে। চা দে বাবা। বড্ড ঘেমে গেছি।
রোজ ঠিক ঠিক মতো বাসে বা ট্রামে ভাড়া দিলে মাসে বিশ-ত্রিশ টাকার ধাক্কা। তাই সুবিধে পেলেই ট্রাম বাসের ভাড়াটা ফঁকি দেয় সমীরণ। আজও দিল। তবে কিনা খুব ভাল ফাকিবাজ হতে গেলে বাস বদল করে করেই যাওয়া ভাল। সময় একটু বেশি লাগে। কিন্তু একনাগাড়ে বেশি দূর গেলে ভাড়া কঁকি দেওয়ার সুযোগ কম। আর অসুবিধে হয় ফাকা বাসে। কিন্তু ভগবানের অসীম দয়ায় আজকাল আর কলকাতায় ফাকা বলে কিছু নেই। গড়িয়াহাটায় একবার নেমে, কিছুটা হেঁটে, তারপর ট্রামে চেপে ওয়েলিংটনের মোড়ে পৌছে গেল সে।
সুরেন ব্যানার্জি স্ট্রিটে তার অফিস। খানিকটা হাঁটতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে উদাস চোখে আকাশটা দেখে নেয় সমীরণ। ভারী নিচু মেঘ থম ধরে আছে, ঝলসাচ্ছে মাঝে মাঝে ঢালবে।
মোড়ে একটা ভুজাওয়ালার দোকান থেকে রোজ ত্রিশ পয়সার মুড়ি কেনে সমীরণ। স্বাস্থ্য সম্পর্কে সে খুবই সচেতন। বাইরের আজেবাজে জিনিস, ভাজা বা বড়া, খোলা খাবার, কার্টা ফল, দোকানের কাপে বা গ্লাসে জল বা চা সে কখনও খায় না। ভুজাওয়ালা তার জন্য ভেজা ছোলা, আদা, গোলমরিচের গুঁড়ো আর বাদাম দিয়ে মুড়ি বানিয়ে দেয়, তেল দেয় না। অফিসে সমীরণের নিজস্ব গ্লাশ আছে, তাইতে চা খাবে মুড়ির পর।
বলতে কী সমীরণের স্বাস্থ্য খুবই ভাল। সচরাচর এত ভাল স্বাস্থ্য দেখা যায় না। হায়ার সেকেন্ডারি ক্লাসে পড়ার সময়েই সে বুঝতে পেরে গিয়েছিল যে লেখাপড়ার মাথা তার তেমন ভাল কিছু নয়। কোনওক্রমে পাশ করে সে যখন কলেজে ভরতি হল তখন তারা দু’চারজন বন্ধু মিলে ভবিষ্যতের পরামর্শ করত। চাকরির বাজার খারাপ, ব্যাবসা হওয়ার নয়, সুতরাং লাইন ধরতে হবে। বিভাস বলেছিল, খেলোয়াড়-টেলোয়াড় হতে পারলে চাকরি বাঁধা।
সমীরণ ইস্কুলে ফুটবল খেলত। কথাটা তার মনে ধরল। আর ধরতেই সে আবার একটা ক্লাবে ভরতি হয়ে ফুটবল খেলতে লাগল। সে খেলার পিছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল। চাকরি। তাই খেলাটা হয়ে দাঁড়াল জুয়াখেলার মতো। সব সময়ে মনে মনে ভাবত এই বুঝি মাঠের বাইরে থেকে বড়সড় কোনও ক্লাবের কর্মকর্তা তাকে দেখছে। কিংবা কোনও বড় অফিসার-টফিসার। খেলা চোখে লাগলেই নিয়ে গিয়ে চাকরিতে বসিয়ে দেবে। অনবরত এসব ভাবত বলে তার খেলা ভাল হত না। বলের পিছনে ছুটে, ল্যাং মেরে আর ল্যাং খেয়ে বৃথাই বড় খেলোয়াড় হওয়ার কপট চেষ্টা করত সে। ক্লাবের বড় খেলা থাকলে তাকে বাদ দিয়ে টিম হত। ফুটবলে কিছু হল না।
বিভাস আর-একদিন বলল, স্বাস্থ্য ভাল করলে পুলিস বা সিকিউরিটিতে চাকরি হয়ে যায়। সেই পরামর্শমতো দুজনেই ব্যায়াম করতে শুরু করে। ব্যায়ামের সুফল তো আছেই। স্বাস্থ্য ভাল হতে লাগল। কিন্তু স্বাস্থ্যবান বা ব্যায়ামবীরের দুর্ভিক্ষ নেই। চাকরিও সস্তা হয়নি। কাজেই ব্যায়ামই সার হল। একদিন সমীরণ হতাশ হয়ে বলল, ধুস!
বিভাস এর পরেও হাল ছাড়েনি। সাঁতারু কুস্তিগীর এইসব হওয়ার জন্য এবং হয়ে চাকরি পাওয়ার জন্য বিস্তর চেষ্টা চালায়।