সুখন ডায়াল করে রিসিভার বৌধায়নকে দেয়।
মন্দা বাড়ি ফিরেছে?
না।–বলেই ওপাশের ভদ্রমহিলা ফোন নামিয়ে রাখলেন।
চূড়ান্ত অভদ্র ওরা। বরাবরই এইরকম। মন্দা বাড়ি না থাকলে বৌধায়ন ফোন করে কোনওদিন কিছু জানতে পারেনি। এমনই ওদের পারিবারিক সম্পর্ক যে, কেউ কারও নাম পর্যন্ত সইতে পারে না।
ধীর হাতে ফোন নামিয়ে রাখার সময়েই বৌধায়নের রাগের স্টিম বেরিয়ে যাচ্ছিল।
ঘরের লোকগুলোর মধ্যে যার মুখে বসন্তের দাগ সেই সবচেয়ে বদমাশের মতো দেখতে। বৌধায়ন নেংচে গিয়ে লোকটার বুকে লাঠির একটা রূঢ় খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, সুখন ঠিক কথা। বলছে, এই শালা?
লোকটা লাঠির গুঁতোয় ‘কোঁক’ করে উঠে বলে, জি।
তুই কে?
ঠেলা চালাই! রামব্রিজ দোসাদ।
বৌধায়ন প্রচণ্ড রাগের চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, কিন্তু তার সেই স্টিম আর নেই। তবু গিয়ে সে অফিসঘরের দরজার ঘষা কাচে চোখ রেখে ভিতরটা দেখতে চেষ্টা করে। কিছু দেখা গেল না। তবে মনে হল, ঘরের ঠান্ডা মেশিনটা এখনও চলছে। দরজার কাচে ভাপ, শীতলতা।
বৌধায়ন দরজায় শব্দ করে বলল, মন্দা। মন্দা ভিতরে আছ?
সাড়া নেই।
বৌধায়ন কুটিল চোখে সুখনের দিকে চেয়ে বলে, ভিতরে এয়ারকন্ডিশনার চলছে কেন?
দিদিমণি বন্ধ করতে ভুলে গেছে।
বৌধায়ন লাঠিটা তরোয়ালের মতো ধরে বলল, আমি আবার পরে মাকে ফোন করব। যদি কোনও গড়বড় হয়ে থাকে তো তোমাকে ছাড়ব না বলে রাখলাম। মাটিতে পুঁতে ফেলব।
সুখনের ভয়-খাওয়া যায়নি, তবু যতদূর সম্ভব দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, কোনও গড়বড় হয়নি। বুটমুট দিদিমণি ভয় খেলেন।
বৌধায়নের পা ঝিলিক দিচ্ছে। কিন্তু রাগের গরমটা রয়েছে। সে ব্যথাটাকে পাত্তা দিল না।
জয়তী দরজার কাছ থেকে বলল, বুধ, চলে এসো। কিছু হয়নি।
বৌধায়ন গড়গড় করে সিংহের মতো ফিরে তাকিয়ে দেখে, দরজায় দশাসই পশ্চিমা ড্রাইভার আর জয়তী দাঁড়িয়ে। ড্রাইভারটার মুখ পুরো বেকুব। জয়তী কিছু গম্ভীর কিন্তু মুখে কোনও উদ্বেগ নেই। বৌধায়ন ফের গাঁক করে ওঠে, কী করে বুঝলে যে কিছু হয়নি?
হলে ওদের মুখ দেখলেই বোঝা যেত! আর মন্দার মাথায় যে একটু ছিট আছে তা আমি ওকে প্রথম দেখেই টের পেয়েছিলাম।
বৌধায়নের রাগের স্টিম যেটুকু ছিল তাও হুশ করে বেরিয়ে গেল। ভারী অবসন্ন বোধ করে সে। আর রাগ কমতেই কুঁচকি পর্যন্ত গোটা পায়ের টাটানি টের পায়। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে দরজার দিকে এগোতেই জয়তী তাকে ধরে। খুব মৃদুস্বরে বলে, বাব্বাঃ, যা বীরত্ব দেখলাম। আজ সবাইকে বলব।
বৌধায়ন শুধু ব্যথার কাতর একটা ওফ শব্দ করে। প্রচণ্ড কষ্টে সে সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে।
বাড়িতে ফিরে পায়ের অসহ্য ব্যথায় বিছানা নিল বৌধায়ন। ব্যথা যতটা তার চেয়ে অবশ্য সে বেশিই কাতর। সারা বিছানায় গড়ায় আর বিড় বিড় করে বলে, এ পা আর ভাল হবে না। চিরদিনের মতো গেল। ওফ।
বাড়িতে খবরটা রটাতে জয়তী দেরি করেনি। খবর পেয়েই মা প্রায় দৌড়ে হাঁফাতে হাফাতে এসে বলে, তুই লাঠি নিয়ে মারপিট করতে গিয়েছিলি? কী সর্বনাশ।
বৌধায়ন ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে, এত কথা বলো কেন তোমরা বলো তো?
ওই জখম পা নিয়ে আমাকে একবারও না বলে কয়ে কোন আকেলে তুই গেলি বুধো?
বৌধায়ন কাতরাতে কাতরাতে বলে, কাছে বসে একটু হাতাপিতি করো তো! বোকো না।
হাতাপিতি ব্যাপারটা বৌধায়নের নেশার মতো। মা অবশ্য ঠাকুমার মতো পারে না। গেলবার নব্বই পার করে ঠাকুমা বোল্ড আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছে। শেষদিন তক শক্ত-সমর্থ ছিল, সিনেমা পর্যন্ত দেখতে গেছে। বৌধায়নের বিশ্বাস ছিল, ঠাকুমা সেঞ্চুরি করবেই। পারল না। সেই ঠাকুমা এই হাতাপিতি ব্যাপারটা খুব ভাল পারত। তুলতুলে নরম তুলোর মতো হাত ছিল তার। কাছে গিয়ে বসলে পাশে শুলে ঠাকুরমার নরম হাত স্বয়ংক্রিয় হয়ে চলে আসত। বৌধায়নের পিছে, গায়ে। পিঠ, বুক হাতিয়ে দিত, খুঁজে খুঁজে তুকুর-পুকুর করে অদৃশ্য গোটা বা ঘামাচি গেলে দিত। ঠাকুমার নখ কখনও বড় হতে পারত না, তাই ভোতা নখের সেই নরম আঁচড়ে আরামে গা শিউরে শিউরে উঠত। এমনই ছিল সেই হাতাপিতির গুণ যে ঘুম এসে পড়ত কখন!
মা অত ভাল না পারলেও চমৎকার নকল করেছে। ভেজা গামছা দিয়ে আগে মা তার ঘেমো মুছিয়ে দিল। তারপর সারা শরীর হাতিয়ে, খুঁটে চুলকে দিতে লাগল। বলল, এমন সর্বনেশে স্বভাব ততা তোর ছিল না কখনও।
হচ্ছে। চিরকাল কি খোকা থাকব নাকি?
মন্দার কী হয়েছিল?
সে কথার জবাব দিল না বৌধায়ন। কাতরতার নানা শব্দ করে হঠাৎ অবসাদে চিত হয়ে শুয়ে হা-ছাড়া গলায় বিড় বিড় করে বলল, মানুষের জন্মটাই বড় ঝামেলার। আমি যেমন গাছ ছিলাম আর-জন্মে ফের তাই হব।
কী বলছিস?
বৌধায়ন মুখ বিকৃত করে বলল, সবকিছুর জন্য তুমিই দায়ি।
কীসের জন্য?
কেন তুমি লেবুবনে গিয়েছিলে? তোমাকে না দেখলে তো আমি মানুষ হয়ে জন্মাতে চাইতাম না। আর জন্মালাম বলেই তো এই ঝামেলা।
আর কোনও কথার জবাব দিল না বৌধায়ন। পাশ ফিরে শুয়ে রইল।
মন্দার বিপদের কথা সে আর ভাবছিল না। কিন্তু তার দমবন্ধ হয়ে আসছিল অন্য এক চিন্তায়। বুকের ভিতরের বড্ড আকুলি ব্যাকুলি।
গভীর রাতেও বার বার ঘুম ছিড়ে যায় তার। পায়ের টাটানো ব্যথা কুমিরের কামড়ের মতো ক্রমে ক্রমে কোমর ধরে ফেলেছে। কিন্তু সে ব্যথাও তুচ্ছ মনে হয়। বুক ছিড়ে ভেতরে অন্যবকম এক রক্তক্ষরণ হয় তার। সে কেন সুখনকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গাল দিল? সে কেন ঠেলাওয়ালাটার বুকে ওরকম ভয়ংকর লাঠির খোঁচা দিয়েছিল?