তা হবেও হয়তো মন্দা। ওর সে এলেম আছে। অনেকবার ও বন্ধুদের ব্যাবসা জিনিসটা বোঝাবার চেষ্টা করেছে। তাইতেই বৌধায়ন টের পেয়েছে যে, মন্দা সত্যিই ব্যাবসা বোঝে। কিন্তু মেয়েদের সম্পর্কে বৌধায়নের শ্লোগান, ব্যাক টু কিচেন। আবার রান্নাঘরে ফিরে যাও। বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। পুরুষেরা বহির্জগতে, মেয়েরা রান্নাঘরে।
দশাসই পশ্চিমা ট্যাক্সিওয়ালাকে তাড়া দিচ্ছিল বৌধায়ন, জলদি! জলদি!
জয়তী বলে, ওরকম কোরো না। কোথায় ভিড়িয়ে দেবে।
বৌধায়নের হাত-পা নিশপিশ করে। সে অস্থিরভাবে বসে বসেই একশোবার এপাশ-ওপাশ করতে থাকে।
সুরেন ব্যানার্জি রোডে অফিসবাড়িটার সামনে নামবার সময়ে বৌধায়নের হাত-পা আড়ষ্ট লাগছিল। ভয় ভয় করছে। কিন্তু পিছোনো যায় না। জয়তী কি কোনও ভরসা? ভেবে সে একবার জয়তীর দিকে তাকায়। জয়তী গম্ভীর! তাকে নামিয়ে দাঁড় করানোর পর এখন নিজের উলি শাড়ির আঁচল গোছাচ্ছে।
বৌধায়ন পকেটে হাত দিয়ে বলল, এই রে। টাকা আনতে ভুলে গেছি।
আমি ভুলিনি।বলে জয়তী তার চামড়ার বটুয়া খুলতে থাকে।
পুরুষ সঙ্গে থাকলে মেয়েরা খরচ করে, এটা একদম পছন্দ নয় বৌধায়নের। তবু এখন তো উপায় নেই। ড্রাইভার যখন মিটার দেখে পয়সার জন্য হাত বাড়িয়েছে তখন বৌধায়ন বলল, থাক মেজ বউদি, ট্যাক্সিটা ছেড়ো না। আমাদের বোধহয় দরকার হবে।
এই বলে সে নেংচে ড্রাইভারের জানালায় এগিয়ে গিয়ে খুব বিনীতভাবে বলে, ভাইসাব, এক লেড়কিকো বহুত খতরনাক… খতরনাক…
বলে থেমে সে জয়তীর দিকে ফিরে বলে, খতরনাক মানে কী বলো তো।
পাজি, বদমাশ।
বিপদের হিন্দি কী?
খতরা।–বলেই আবার ফিক করে হাসে জয়তী।
বৌধায়ন গম্ভীর হয়ে বলে, র্যালা দিয়ো না। সপ্তাহে দুটো করে হিন্দি ছবি দেখলে আমারও সব মুখস্থ থাকত।
এই বলে সে ফের ড্রাইভারের দিকে ফিরে বলে, এক লেড়কি বহুত খতরামে পড়া। আপ জারা মেহেরবানি করকে হামারা সাথ আনে সে বহুত উপকার হোগা…
ড্রাইভার অবাক হয়ে গিয়েছিল, এবার বলল, বাংলায় বলুন না! আমি বুঝতে পারি।
বৌধায়ন পিছনে জয়তীর হাসির খুক শব্দ পেল। তবু মাথা ঠিক রেখে বলল, একটি মেয়ে খুব বিপদে পড়েছে। একটু যদি সঙ্গে আসেন। আমরা আপনার গাড়িতেই ফিরব।
ট্যাক্সিওয়ালা একটু ইতস্তত করে। কলকাতার ট্যাক্সিওয়ালারা সাধারণত সওয়ারির মামলায় যেতে রাজি হয় না। কিন্তু বৌধায়নের আহত পা আর মুখের পবিত্রতা দেখে এ লোকটা হঠাৎ রাজি হয়ে গেল। বলল, চলুন, দেখছি।
গাড়ি লক করে লোকটা পিছনে পিছনে উঠে আসে। বৌধায়ন এখন অনেকটা সাহসের সঙ্গে সিড়ি ভাঙতে থাকে। বেশ ব্যথা লাগছে পায়ে। তিরের ফলার মতো গোড়ালি থেকে খচখচ করে ব্যথা উঠে আসছে কুঁচকি পর্যন্ত। কাস্টিং আর ব্যান্ডেজ-ভারী পা তুলতে কষ্ট হচ্ছে। জয়তী তিনতলা পর্যন্ত খুব নিপুণভাবে তার ভার সামলে ঠেলে তুলল।
ওই সামনের ঘরটা।–বলে বৌধায়ন জয়তীর হাত ছাড়িয়ে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে এগোল।
পিছন থেকে জয়তী সাবধান করে দেয়, হুট করে কাউকে মেরে বোসো না। এটা প্র্যাকটিক্যাল জোকও হতে পারে মন্দার।
ঠিক ঘরের চৌকাঠেই সুখনের সঙ্গে দেখা। চেনা মুখ, বহুবার তাদের চা দিয়েছে লোকটা।
লাঠিটা দুহাতে শক্ত মুঠোয় বাগিয়ে ধরা ছিল, সেই ভঙ্গিতেই গাঁক করে ওঠে বৌধায়ন, এই শুয়োরের বাচ্চা! মন্দা কোথায়?
সুখনের মুখটা শুনোই ছিল। বৌধায়নের গাল শুনে আর মূর্তি দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। ভীষণ মিয়োনো গলায় বলল, জি, দিদিমণি তো একটু আগে চলে গেলেন। আমি ট্যাক্সি ধরে দিয়েছি।
বৌধায়ন মেঝেয় লাঠিটা একবার আছড়ে নেয়। রাগে তার গা বি-বি করে ওঠে। মাথায় আগুন। গলায় সেই আগুনের হলকা বেরোয়, ঠিক করে বলল কী হয়েছে? মন্দা আমাকে ফোন করেছিল। আমি ঘর দেখব, রাস্তা ছাড়ো।
সুখন কুণ্ঠিত পায়ে সরে গিয়ে রাস্তা দেয়।
ঘরের মধ্যে একপাল আধা-ভিখারি চেহারার মানুষ সিটিয়ে বসে আছে ভয়ে। প্রত্যেকে সজাগ, সতর্ক জুলজুল করছে চোখ। পালানোর ফিকির ঘুরছে তাদের মগজে। রাতে শুতে এসে বেকার এই বিপদ।
বৌধায়ন প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকায়। এই সমাজের লোকজনকেও সে ভাল চেনে না। প্রথম নজরে মনে হয়, এরা ভয়ংকর বদমাশ, পাজি। রেপ, খুন সব করতে পারে। আবার ভাল করে দেখলে মনে সন্দেহ উশখুশ করে, পাজি হওয়ার মতো যোগ্যতাই তো এদের নেই। তেমন তেমন পাজি হতে গেলেও তো কিছু এলেম চাই। পাইজ্যামির সেই মেধা কি এদের আছে? তবু বৌধায়ন রক্তচোখে চারিদিকে চেয়ে ফের গাঁক করে ওঠে, ওই অফিস দুটোর দরজা খোলল। আমি দেখব। আর এদের আটকে রাখো, কেউ নড়লেই মাথা ফাটিয়ে দেব।
কেউ নড়ল না।
সুখন খুব শুখো গলায় নরম সুরে বলে, চাবি তো দিদিমণি নিয়ে গেছে।
বৌধায়ন পাগলের দৃষ্টিতে সুখনের দিকে চেয়ে বলে, দু’নম্বরি কথা ছাড়ো। ঠিকসে বলল।
সুখন প্রথমটায় কথা বলতে পারে না, তারপর বলে, এরা সব গরিব গাঁওয়ার আদমি। রোজ রাতে এসে শুয়ে থাকে, সবেরে চলে যায়। দিদিমণি আজ হঠাৎ চলে এসে এদের দেখে ডর পেয়েছিল, আমি তখন ছিলাম না। কোনও হরজা হয়নি, সব ঠিক আছে। বিসোয়াশ করুন।
বৌধায়ন একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বলল, ঠিক আছে। মন্দার বাড়িতে ফোন করো। আমি দেখতে চাই ও বাড়ি পৌঁছেছে কি না।