কাকে খবর দেবে তা মাথায় এলই না তার। মাথার চুল দু’হাতে মুঠো করে ধরে সে গড়াগড়ি দিতে লাগল বিছানায়। তারপর খাড়া উঠে বসল, বিড়বিড় করে বলল, আমি যাব। তারপর ব্যান্ডেজ বঁধা পায়ের দিকে ভয়ার্ত চোখে চেযে রইল সে। নিজের ওপর রাগে ঘেন্নায় নীল হয়ে গেল সে। ঘামতে লাগল অসম্ভব উত্তেজনায়। মন্দা কেন নিজের বাড়িতে ফোন না করে তাকেই করতে গেল? অন্য কাউকে না ডেকে তার পা ভাঙা জেনেও কেন তার কাছেই পাঠাল এস ও এস?
মন্দার বাড়িটা বড় অদ্ভুত। সে বাড়ির কেউ কাউকে দেখতে পারে না। মন্দার বাবা মার মধ্যে গত দশ বছর ধরে নাকি কথাবার্তা নেই। মন্দার সঙ্গে তার বাপ-মায়ের সম্পর্কও ঝগড়ার। মন্দার দুই দাদার একজন ইটালি, অন্যজন সুইজারল্যান্ডে সেটেল করেছে। সংসারের অশান্তির জন্যই তারা আসছে না বলে মন্দার ধারণা। তার আর এক ভাইও পালানোর পথ খুঁজছে। কাকে ডাকবে মন্দা? আর বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতদের সঙ্গেও মন্দার তেমন বনিবনা হয় না। বৌধায়নের সঙ্গে যে হয় তাও নয়। তবু বৌধায়ন মন্দাকে পছন্দই করে বোধহয়। এখন বিপন্ন মন্দার জন্য প্রাণ আনচান করে তার।
প্রাণপণে চেঁচিয়ে বৌধায়ন বাড়ির চাকরকে ডাকতে লাগল, নরেন! নরেন!…কোথায় যে যায় রাস্কেলটা!
চেঁচানিতে নরেন এল না, এল জয়তী, সাজছিল। মেয়েদের অভ্যাস সাজের সবশেষে শাড়ি পরবে। জয়তীর ভ্রু আঁকা, লিপস্টিক লাগানো, পাউডার বোলানো শেষ হয়েছে, শাড়ি পরার আগে ব্লাউজটা বদলাতে যাচ্ছিল বোধহয়, কিন্তু সেটা পরার সময় পায়নি। বৌধায়নের জরুরি ডাক শুনে ওই অবস্থাতেই মেঝে কাপিয়ে দৌড়পায়ে এসেছে। শাড়িতে গা ঢাকতে ভোলেনি, তবু পাতলা শাড়ির ভিতর দিয়ে তার কালো গায়ে সাদা ব্রেসিয়ার দেখা যাচ্ছে।
বৌধায়ন মুখ ফিরিয়ে নিল।
কী হয়েছে বুধো?
ভীষণ বিপদ। আমার এক বান্ধবী…চেনো তো মন্দাকে! এইমাত্র ফোন করে বলল, তার ভীষণ বিপদ। যেতে হবে।
তুমি যাবে?
বৌধায়ন ভয়ংকর মুখ বিকৃত করে বলল, যেতেই হবে। এবং এক্ষুনি।
তুমি যাবে কীভাবে? বরং ঠিকানা দাও, আমি যাচ্ছি।
বৌধায়ন আঁতকে উঠে বলে, না। মন্দা ইজ গোয়িং টু বি.ওঃ সে বিচ্ছিরি ব্যাপার। সেখানে একা গেলে তোমারও রেহাই নেই। গাড়িটা আছে?
না তো! বাবা না ফিরলে গাড়ি পাবে কোথায়?
তবে শিগগির ট্যাক্সি ডাকো। শিগগির! একমুহূর্ত সময় নেই।
বলতে বলতেই বৌধায়ন খাট থেকে এক পায়ে নেমে দাঁড়াল। ডান পায়ের দিকে তাকাল আবার। নিজের গায়ে তার থুথু দিতে ইচ্ছে করছে।
জয়তী খুব দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরোল, চেঁচিয়ে বলল, তৈরি হও, আমিও সঙ্গে যাচ্ছি। শাড়িটা পরা বাকি শুধু।
বৌধায়ন আপনমনে স্বগতোক্তি করল, শুধু শাড়ি নয়, ব্লাউজও। ছিঃ ছিঃ!
ডান পায়ে মেঝেয় ভর দেয় বৌধায়ন, খুব সাবধানে। লাগছে একটু। তবে অসহ্য নয়। খুঁড়িয়ে হাঁটা যাবে। চোট-পায়ে বেশি ভর দেওয়া যাবে না।
পায়জামার ওপর সে একটা পাঞ্জাবি চড়াল ওয়ার্ডরোবের কাছে গিয়ে। সারি সারি প্যান্ট ঝুলছে, কিন্তু গোদা পা ঢুকবে না বলে প্যান্ট পরার প্রশ্নই ওঠে না।
জয়তী দেরি করেনি। বৌধায়ন দরজার কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই দেখে জয়তী বারান্দার ওপাশের ঘর থেকে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে পাল্লা টেনে বন্ধ করল। বৌধায়নকে দেখে বলল, ট্যাক্সি এসে গেছে। যেতে পারবে তো?
পারব। শোনো, বাবার রুপো বাঁধানো বেতের লাঠিটা দাও।
ভর দেবে?
দুটোই হবে। ভর প্লাস অস্ত্র।
মারপিট করবে নাকি?বলে বড় চোখে তাকায় জয়তী।
দরকার হলে। মন্দা ইজ ইন গ্রেট ডেঞ্জার।
জয়তী এতক্ষণ খুব সিরিয়াস ছিল, এইবার ফিক করে হেসে ফেলে বলল, তুমি? বোলো না, বোলো না।
ভ্রূকুটি কাকে বলে তা সঠিক জানে না বৌধায়ন, তবে কথাটা বইতে পড়েছে। এখন সে খুব প্রাণপণে ভ্রুকুটি করার চেষ্টা করে। বোধহয় ভ্রুকুটিটা হয় কারণ জয়তী কথা না বাড়িয়ে পক্ষিণীর মতো নাচের পায়ে উড়ে গিয়ে লাঠিটা নিয়ে আসে।
বৌধায়ন লাঠিটা নিয়ে বলে, তুমি আবার সঙ্গ নিলে যে!
আমি না হলে কে নেবে? বাড়িতে কেউ তো নেই। নরেনও বাজারে।
কারও দরকার ছিল না।
বেশি বীরত্ব দেখিয়ো না। কচি খোকার মতো হাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থা, আবার কথা ঝাড়ছে। মেয়েটার কী বিপদ বললে না তো!
বৌধায়ন দেয়াল ধরে ধরে এগোয়। মুখ ভয়ংকর বিকৃত। লাগছে একটু। কিন্তু বেশি লাগতে পারে ভয়ে সে প্রতি পদক্ষেপেই কুঁচকে যাচ্ছে। তবু এগোয়। ডানদিকে দেয়ালের কাছ ঘেঁষে এসে জয়তী তার বগলে কাঁধের ঠেকা দিয়ে বলে, শরীরটা ছেড়ে দাও।
পারবে?
না পারলে বলছি?
বৌধায়ন নাক কুঁচকে বলে, এত সেন্ট মাখো কেন বললা তো! ওসব গন্ধে আমার গা গুলোয়। ছাড়ো।
বেশি বোকো না। ফ্রেঞ্চ পারফিউম। কত দাম জানো?
দামটাই শিখেছ। নয়নার ফাংশনে গেলে না?
ড্রপ করছি।
মারও যে যাওয়ার কথা ছিল তোমার সঙ্গে।
কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে মা ডিসিশন চেঞ্জ করলেন। আমি একা যাচ্ছিলাম।
যাও না।
না। তার চেয়ে এই ফাংশনটাই বেশি ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।
ইয়ারকি কোরো না। লাইট ব্যাপার নয়। মন্দা সহজে বিপদে পড়ে না।
জয়তী আবার সিরিয়াস হয়ে গেল। সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে লাগল বৌধায়নকে।
মন্দার বাবার অফিসটা বৌধায়ন চেনে। কয়েকবার ছুটির দিনে মন্দা বেশ কয়েকজন বন্ধু এবং বান্ধবী নিয়ে তার বাবার কঁকা অফিসঘরে গিয়ে এয়ার কন্ডিশন করা ঘরে বসে আড্ডা দিয়েছে। ভারী নিরিবিলি জায়গা এবং নিরাপদও। গরমের দিনে ঠান্ডা ঘরে বসে আড্ডা খারাপ নয়। তাছাড়া অফিসটা মন্দার কাছে নেশার মতো। বাবা না থাকলে ও অফিসে গিয়ে ফাইলপত্র খুলে দেখে, ব্যাবসার অন্ধিসন্ধি বোঝার চেষ্টা করে। মন্দা বলে, আমি হব ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট।