কিছু একটা করবে। পাথরের মতো স্থাণুভাব ঝেড়ে ফেলে মেঝে থেকে একে একে উঠে দাঁড়াচ্ছে তারা। কালো, কুৎসিত, নোংরা মানুষ। ভয়ংকর মানুষ। কারা এরা? কোত্থেকে এল?
বুদ্ধি হারিয়ে যাচ্ছে। শরীরে ভয়ের রিমঝিম। মন্দা তবু দু পা এগোল। আবার এক পা। বাবার অফিসের দরজাটা পেয়ে গেল হাতের নাগালে। সিড়িতে উঠবার সময়ে চাবি বের করে রেখেছিল হাতে। কাঁপা হাতে চাবিটা বাড়াল দরজার দিকে।
এখন একমাত্র সামনে এগোনোরই পথ আছে। কিন্তু পারবে কি মন্দা ছোট অফিসঘরটায় ঢুকতে? তার আগেই কি ওরা তাকে ধরবে না চেপে?
কিন্তু মন্দা পারল। কীভাবে পারল তা বুঝল না। কিন্তু দরজাটা খুলে গেল, গ্রাস করল তাকে, তারপর নিরাপদে বন্ধও হয়ে গেল।
রিভলভিং চেয়ারটায় বসে, হাতের নাগালে টেলিফোন পেয়ে মন্দা ভারী অবাক হয়ে যায়। ওরা যদি লুটই করবে তাকে তবে এ ঘরে ঢুকতে দিল কেন? ওরা কি জানে না এ ঘর থেকে মন্দা পুলিশ ডাকতে পারে?
টেলিফোনটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যে নম্বরটা প্রথম মনে পড়ে তা ডায়াল করতে থাকে। বিড়বিড় করতে থাকে, বৌধায়ন। ওর তো পা ভাঙা! তবু কেউ না কেউ তো জানবে।
ফোন করে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মন্দা। কী করবে? সারা শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। শিউরে উঠছে সে৷ বাইরে চাপা স্বরে কথা বলছে ওরা। দরজায় ছিটকিনি দেওয়ার শব্দ হল না? অনেক পায়ের শব্দ খসখস করে ঘুরছে, ফিরছে। কে যেন বলল, মালকিন বাটে!
মন্দা ঘেমে ঘেমে অবসন্ন হয়ে যাচ্ছিল। এয়ার কন্ডিশনারটা সম্পূর্ণ নিজের অজান্তে চালিয়ে দেয় সে। তারপর অমোঘ নিয়তির জন্য অপেক্ষা করে।
সময় কাটে। বৌধায়ন আসবে না সে জানে। কিন্তু আর কাকে ফোন করা যায়? বাড়িতে তা হলে মা জানবে, সবাই জানবে।
খানিকক্ষণ ঠান্ডা ঘরে বসে জুড়িয়ে গেল সে। মাথাটা কিছু পরিষ্কার। উঠল। পা টিপে দরজার কাছে এল। বাইরে এখনও চাপা গলায় কথা হচ্ছে। ষড়যন্ত্র? আজ রাতটা মন্দার বোধহয় কাটল না। কাল হয়তো সে সমীরণকে ছাঁটাই করবে। কেন, কোন সাহসে লোকটা অপেক্ষা করেনি?
পর মুহূর্তেই বিদ্যুৎ খেলল মাথায়। যদি সমীরণকেও ওরা খুন-টুন করে থাকে? হয়তো আচার্যিকাকুর ঘরে তার লাশটা ফেলে রেখেছে।
চিন্তাটা সহ্য হল না মন্দার। এক টানে দরজাটা খুলে প্রচণ্ড চেঁচিয়ে বলল, খবরদার! আমি পুলিশে ফোন করেছি।
সামনে আবার পাথরের মতো স্তব্ধতা। টেবিলের লোকটা উঠে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা হতভম্ব। হঠাৎ সেই লোকটা হাতজোড় করে বলে, নমস্তে মেমসাব। মাফি মাঙে। আমরা রাতে এইখানে লেটে যাই। শুতনেকো জাঘা কুথা পাব, গরিব আদমি সব। মাফি মাঙে।
মন্দার কথাটা প্রথমে বিশ্বাস হয় না। তারপর হয়। তাই তো! এরা রিকশা বা ঠেলা চালায়, সারাদিন খাটে। রাতে যাবে কোথায়? কলকাতায় তো এত লোকের শোওয়ার জায়গা নেই!
সব লোকই দাঁড়িয়ে গেছে, বেশিরভাগই জোড় হাতে বিনয় করে বলে, নমস্তে মালিক। বাকি যারা তারা কথা বলতেও সাহস পায় না। মুখ লুকিয়ে রাখে।
এরা যেতে দেবে তাকে?
মন্দা আঁচলটা ঘুরিয়ে মুখ মুছে শরীরটা ঢাকা দিয়ে নেয়। মনটা নরম লাগে। আস্তে করে বলে, আমি পুলিশে খবর দিইনি। তোমরা থাকতে পারো।
চোঁয়াড়ে লোকটা ভারী খুশি হয়ে বলে, চোরওর নেহি মালিক, গরিব গাঁওয়ার লোক সব। মাফি মাঙে।
একজন বলে, বুঢ়া কুছু নেহি মালিক। স্রেফ লেটে যাই। সবেরে ফিন মাল ঢুতে চলিয়ে যাব।
মন্দা আর শোনে না। তার পেটের ভিতর যেটুকু ব্ল্যাক নাইট ছিল সব করুণাধারা হয়ে গেল এইমাত্র। চোখে জল হয়ে বয়ে এল রক্তের ভিতরে মিশে থাকা সেই ঘোড়সওয়ার।
মন্দা বলল, থাকো, থাকো। আমি কিছু মনে করিনি। কী ভাল লোক এরা! কী সুন্দর মানুষ সব।
০৬. বীরত্বের কাজ
০৬.
বৌধায়ন কোনওদিনই কোনও বীরত্বের কাজ করেনি। বীরত্বের কথা দূরে থাক সারাজীবনে তাকে তেমন কোনও কাজই করতে হয়নি। বাবা দাদারা চাকরি-টাকরি করে। বড়লোক না হলেও অবস্থা খারাপ নয়। নিজেদের পুরনো বাড়ি, বাড়িতে টেলিফোন, ফ্রিজ এসব তো আছেই, একটা গাড়িও আছে। আরও কিছুদিন চাকরিবাকবি না করলেও তার চলবে। তাকে বাজার করতে হয় না, রেশন তুলতে বা ইলেকট্রিক বিল দিতে যেতে হয় না, কোনও ফরমাশ খাটতে হয় না, বরং উলটে তাব ফরমাশেই লোকে অস্থির। বড়দা আর মেজদা মাকে বকে, ছোটটাকে একদম গুড ফর নাথিং বানিয়ে রাখলে মা! সামনের বছর তার জাপান যাওয়ার কথা আছে, সেই ভেবে মা এখন থেকেই অস্থির। বারবারই বলে, তুই কি পারবি গিয়ে থাকতে?
ব্যাপারটা আসলে তা-ই। এ বাড়ি আর মা তাকে দুর্গের মতো আড়াল করে রেখেছে। কোনওদিন কোনও ভারী কাজ করেনি বলে এখন সে এক গ্লাস জল ভরেও খেতে পারে না। দোকান থেকে একটু জিনিস বয়ে আনতে হলে সে ঘেমে জল হয়। একবার বাড়ির ওপর রাগ করে নিজের কাজ নিজে করতে গিয়ে গেঞ্জি আর রুমাল কেচেছিল। তাইতে তার বুক ব্যথা করেছিল তিনদিন।
ফোনটা যখন আসে তখন আধশোয়া হয়ে কথা বলছিল বৌধায়ন। বলতে বলতেই উঠে বসে। ফোনটা রাখার পর বিড়বিড় করে ‘রেপ! মলেস্টেশন’ বলতে বলতে সে কই মাছের মতো দাপাতে লাগল বিছানায়। মন্দার কী হবে? এতক্ষণে কী হয়ে গেল না জানি!
বৌধায়নের এই একটা জিনিস আছে। যাকে বলা যায় ফিলিং। অসম্ভব সহানুভূতি তার। অন্যের জন্য অল্পেই অস্থির হয়ে পড়ে। নিজের জন্য যতটা হয় প্রায় ততটাই। কারও কিছু ক্ষতি হবে বা কেউ কোনও কষ্ট পাবে, মরে যাবে এ সে ভাবতেই পারে না। ছেলেবেলা থেকেই সে মাকে জিজ্ঞেস করে আসছে মা, তুমি মরে যাবে না তো? কোনওদিন মরবে না তো!