না।
আমার খুব মনে পড়ে। বড় বেশি সাত্ত্বিক হয়ে গেল শালা।
আমাদের কি অন্য কোনও কথা নেই বলু?
আছে। অনেক কথা আছে। আমি তো কথার বস্তা হয়ে আছি। কিন্তু সেসব কথা তোমার ভাল লাগবে না। টায়ার ফঁসবার কথা, লম্বা ট্রিপের কথা, লাইট জোকস, আমি নষ্ট হয়ে গেছি মন। কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না’ গানটার সব কথা মনে পড়ে না।
মন্দার চোখ ঝিকিয়ে ওঠে। বলে, আমাকে অ্যাভয়েড করছ?
তোমাকে?— হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে বলবীর।
ঠিক এইসময়ে বেয়ারা এসে বলে, আপকা ফোন সাব।
বলু অস্পষ্ট ‘এক্সয়ুজ মি’ বলে তাড়াহুড়ো করে উঠে যায়। একটু বাদে ফিরে এসে কপালের ঘাম পাঁচটাকার রুমালে মুছে বলে, ফিট হয়ে গেছে।
মন্দা বড় বড় চোখে চেয়ে বলে, তুমি তোমার গ্যারাজে এখানকার ফোন নম্বর দিয়ে এসেছিলে?
হু। দোষ হয়নি তো?
তার মানে তোমার মন আমার ওপর নেই।
বিজনেস ইজ বিজনেস মন।
মন্দা চুপসে এতটুকু হয়ে যায় অভিমানে। ব্ল্যাক নাইটও তার মনটাকে সজল করেছে, নরম কাদার মতো মেখে ফেলেছে। তাতে এখন সহজেই গভীর ছাপ পড়ে। সে গুম হয়ে বসে থাকল খানিক, তারপর বিনা নোটিশে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমি যাচ্ছি।
আরে দাঁড়াও! তোমাকে পৌঁছে দেব।
না বলু। আমি একজনকে বসিয়ে রেখে এসেছি। সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
কাকে মন? নতুন কেউ?
যা ভাবছ তা নয়। আমাদের অফিসের একজন কর্মচারী। সে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।
তোমাকে পৌঁছে দেবে? কেন, আর ইউ ইন ডেঞ্জার?
মন্দা সামান্য অস্বস্তি বোধ করে। এতে ঠিকই যে তার পক্ষে একা বাড়ি ফেরাটা কোনও সমস্যা হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আজকাল তার কেন যে একটা বিচিত্র শিরশির করা ভয়ের ভাব হয়। কেবলই মনে হয়, এই বুঝি কেউ পিছনে আসছে, লক্ষ করছে, সুযোগ খুঁজছে। তার ভয়, একদিন বুঝি কোনও সুযোগে ধর্ষণকারীরা ঘিরে ধরে তাকে তুলে নিয়ে যায়। কিংবা হঠাৎ কোনও খুনি ইস্পাত ভরে দেয় হৃৎপিণ্ডে। কোনও মানে নেই, তবু হয় ওরকম।
মন্দা তার খাটো চুল ঝাপটা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলে, বলু যাও। তোমার বিজনেস ওয়েট করছে। আমাকে দিয়ে তোমার কী হবে?
ওরকম বোলো না মন। শোননা, আমি শিগগিরই জাহাজ কিনব। আই অ্যাম গোয়িং ইনটু ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড। আমার ইচ্ছে জাহাজের প্রথম ট্রিপে তোমাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাব।
কী সুন্দর প্রস্তাব!
বিশ্বাস করছ না?
করছি। এখন যাও।
খুবই ফাঁকা আর একা লাগছিল মন্দার। এরকম ছাইয়ের মতো বিকেল সে অনেককাল কাটায়নি। বিকেলটা কেটে গেছে। রাত হতে চলল। ব্ল্যাক নাইট অনেকটা একঘেয়েমি কাটিয়ে দিয়েছে। তবে টিপ টিপ করছে মাথাটা। বলু তাকে জিপে তুলে সুরেন ব্যানার্জি রোডের ভিতরে বাবার অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময়ে বলে গেল, জাহাজের কথাটা ভুলো না। আই অ্যাম সিরিয়াস।
মন্দা ফিরে তাকাল না। আস্তে আস্তে সিড়ি ভেঙে তেতলায় উঠল। খুব অন্যমনস্ক। অন্যমনস্কতায় সিড়ির মুখে, করিডোরে ছায়া ছায়া কিছু লোককে দেখতে পেল। তাকে দেখে দু-চারজন দ্রুত সরে গেল এদিক ওদিক।
মন্দা তার বাবার অফিসঘর পর্যন্ত উঠতে যথেষ্ট হাঁফিয়ে পড়েছিল। ব্ল্যাক নাইট রক্তে ঘোড়া ছুটিয়েছে এতক্ষণে। তার ঘাম হচ্ছে, হাঁসফাস লাগছে, মাথাটা বেতাল, হাঁটু অবশ, বুক সামান্য জোরে ঢিপ ঢিপ করছে চোখে একটা কুয়াশার পর্দা পড়ে দৃষ্টি অস্বচ্ছ।
বড় ঘরটায় ঢুকেই সে থমকে গেল। পর মুহূর্তেই শিউরে উঠে ভাবল, সে ভুল জায়গায় এসেছে। এ নিশ্চয়ই তার বাবার অফিস নয়। বড় ঘরের মেঝেয় অন্তত দশ বারোজন লোক শুয়ে বা বসে আছে। প্রত্যেকের চেহারাই কালো, বেশির ভাগই আদুড় গায়ে। সামনের বড় একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর যে লোকটা আধশোয়া হয়ে হা করে তার দিকে চেয়ে আছে সে লোকটার মুখে বসন্তের দাগ, কপালে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন আর ওরকম বদমাইশের মতো মুখ জন্মে দেখেনি মন্দা। ঘরে তীব্র বিড়ির গন্ধ। না, বিড়ির সঙ্গে আরও কিছু আছে। মুখ ফেরাতেই মন্দা দেখে আচার্যিকাকুর অফিসঘরের বন্ধ দরজায় ঠেস দিয়ে বসা একটা বিশ্রী চেহারার মাঝবয়সী লোক মুখ থেকে একটা বোতল নামিয়ে গামছায় আড়াল করল। একসময়ে মন্দার পুরুষ বন্ধুদের কেউ কেউ সিগারেটের মশলা ফেলে গাঁজা ভরে খেত। গাঁজার গন্ধটা চেনে মন্দা। এত গন্ধের মধ্যে সে কি গাঁজার গন্ধও পাচ্ছে একটু?
চারদিকে পাথরের মতো স্তব্ধতা। একঘর লোক স্ট্যাচু হয়ে তাকে দেখছে। মন্দাও নড়তে পারছে না। ভুল, সম্পূর্ণ ভুল ঠিকানায় এসেছে সে। এক্ষুনি চলে যেতে হবে, পালাতে হবে। কিন্তু আবার সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, দুটো ছোট অফিসঘরের দবজায় প্ল্যাস্টিকের নামের ফলকে লেখা, বি রায় আর এ আচার্য। এ তো তার বাবারই অফিস। সমীরণ নেই।
সুখন! সুখন!—ডাকল মন্দা।
কেউ সাড়া দিল না। টেবিলের ওপর লোকটা ধীরে ধীরে উঠে বসে। তার চোখ জ্বলছে। মন্দা ঘরের একটু ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়েছিল। শুনতে পেল, তার পিছনে দরজার পাল্লা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তেলহীন কবজার ককিয়ে ওঠা শব্দ করে। চকিতে ঘাড় ঘোরায় সে। দেখে, ভেজানো দরজার গায়ে লতিয়ে আছে একটা আধন্যাংটা লম্বা কালো মানুষ।
মন্দা জানত এরকম কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছে। এই লোকগুলো কী করবে মন্দাকে? কেড়ে নেবে? সর্বনাশ করবে কিছু? খুন করবে?