আমার চেয়ে বেশি?
আরে তুমি তো লাখপত্তির হিরোইন। আমি শুখা গরিব, আমার মগজে এখন পাংচার টায়ার হাওয়া ছাড়ছে।..তুমি শুঃ-এর দোকানে চলে যাও আমি জিপ নিয়ে তুরন্ত আসছি।
কতক্ষণ?
হাফ অ্যান আওয়ার।
বার-এ আমি একা বসতে পারব না।
তবে রেস্টুরেন্টে বসে যাও। আমি আসছি। দুটো ড্রাইভার কিছু মাল টেনেছে, দুটোকে কয়েকটা লাথ জমিয়ে আসছি।
মন্দা ফোন ছেড়ে রেস্টুরেন্টের টেবিলে গিয়ে বসল। একা এবং ভীষণ একা।
বলু অর্থাৎ বলবীরকে তার যে খুব পছন্দ তা নয়। ওর সূক্ষ্ম অনুভূতি বড্ড কম। একসময়ে যখন কলেজে পড়ত তখন দুর্দান্ত হকি খেলত, ভাল ডিবেটার ছিল, ছাত্রও খারাপ ছিল না। তারপর আস্তে আস্তে পারিবারিক ব্যাবসাতে নেমে লরিওয়ালা হয়ে গেল! আজকাল লরিওয়ালাদের ভাষাতেই কথা বলে। তার গোটা দশেক হেভি ডিউটি ট্রাক হরিয়ানা, দিল্লি থেকে গৌহাটি ডিব্ৰুগড় ট্রিপ মারে। দেদার টাকা। প্রতি বছর দুটো-চারটে করে ট্রাক কেনে। আগে মাতৃভাষা পাঞ্জাবি বলতে পারত না, তার চেয়ে ঢের ভাল বলত বাংলা। ওর জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে, বাঙালি পাড়ায়, বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে বড় হয়েছে। কিছুদিন শান্তিনিকেতনে ছিল। ভরাট গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারত।
কফি শেষ করার আগেই বলু চলে এল। পেল্লায় চেহারা হয়েছে। হাতে বালা, গালে কিছু দাড়ি, নাকের নীচে গোঁফ, মাথায় বাহারি মেরুন পাগড়ি। ঢুকেই উদভ্রান্তের মতো চারদিকে চাইতে লাগল। সবাই ওকে দেখছে। চেহারাটা দশাসই বটে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দেখবার জিনিস ওর পোশাক। এই গরমেও বলু পুরো সুট পরে আছে, গলায় বিশাল চওড়া টাই। এদিক ওদিক তাকিয়ে মন্দাকে দেখে বিশাল গলায় বলল, হাই!
মন্দা ওকে ভাল করে মেপে নিচ্ছিল। কাছে এসে উলটোদিকে বসতেই বলল, ষাঁড় কোথাকার!
মোটা বলছ? কিন্তু ফ্যাট নেই। শুধু মাংসের ডায়েট। নাথিং এলস। পেটটা দ্যাখো। বলে কোটের বোতাম খুলে বলল, নাও, খিমচে ধরে দেখো, নো ফ্যাট।
এটা প্রকাশ্যে জায়গা বলু। ভালগারিটি একদম নয়।
খুব খোলা হাসি হেসে বলু বলে, ইন ক্যালকাটা এভরিবডি ইজ ড়ুয়িং এভরিথিং ইন পাবলিক। যাকগে মন, সন্ধের পর আমি জলীয় জিনিস বলতে একটাই বুঝি। চলল।
কোথায়?
চলো না!
মন্দা উঠল এবং গেল। লালরঙা ধূলিমলিন জিপগাড়িটা যথেষ্ট জোরে চালিয়ে এবং ঝাকুনি দিয়ে তাকে বলু সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের ওপর একটা বারে নিয়ে গিয়ে বসে। এবং তক্ষুনি মন্দা বুঝতে পারে, বিকেলটা তার নষ্টই হল আজ।
বলু বার দুই তার দুটো ট্রাকের জন্য দুশ্চিন্তার কথা বলতে শুরু করল এবং ফাঁকে ফাঁকে চার পেগ রাম খেয়ে নিল। মন্দা এক পেগ ব্ল্যাকনাইট নাড়াচাড়া করছিল। জমছিল না। বলু অনেক দূরের জগতে চলে গেছে। সবাই দূরে চলে যাচ্ছে। আজকাল মন্দার কাউকেই তেমন ভাল লাগে না। যেমন ভাল লাগছিল না চিলি চিকেন বা প্রন কাটলেট।
বলুর সঙ্গে কবে কীভাবে পরিচয় হয়েছিল তা কিছুতেই মনে পড়ল না মন্দার। এমনিতেই আজকাল কিছু মনে পড়তে চায় না, তার ওপর ব্লাক নাইট পেটে গিয়েই খ্যাপা কুকুরের মতো তার মগজে কামড়ে ধরেছে।
বলু হঠাৎ বলে, আমি কি নষ্ট হয়ে গেছি মন?
নষ্ট হবে কেন? তুমি টাকা কামাচ্ছাে।
সেইটেই তো নষ্ট হয়ে যাওয়া। আজকাল গলায় সুর খেলে না, লাইট ফুর্তি করতে ইচ্ছে করে, খুব টাকার নেশায় পেয়েছে।
মন্দা ক্ষীণ গলায় বলে, পুরুষে তো টাকা কামাবেই।
আই ওয়াজ নট দ্যাট টাইপ। আমার সঙ্গে তিলকের খুব জমত। আমার আর ওর টাইপ একরকমের। কিন্তু তিলক ওর টাইপ বহাল রাখল, আমি বিজনেসম্যান হয়ে গেলাম।
আর খেয়ো না, তোমার নেশা হচ্ছে।
চার পেগ আমার মাপা। এক ফোটা বেশি খাই না। এতে যা হওয়ার হয়। না মন, নেশা-ফেশা নয়। তিলকটা ভেঙ্গে পড়ল চাষবাস করতে। আমি পারলাম না কেন?
মন্দা চুপ করে গ্লাসের গায়ে তার লম্বাটে প্রতিবিম্ব দেখল। মেন বিকৃত, লম্বা, শাকচুন্নির মতো ছায়া পড়েছে তার।
তিলককে তুমি ভালবাসতে মন?
মন্দা মাথা নেড়ে বলল, বলতে পারব না। বলু, আমার কিন্তু একটু নেশা হচ্ছে।
ভেবো না। পৌঁছে দেব। আর এক পেগ নেবে?
না। আমার তো সহ্য হয় না। তোমাদের মতো মাতাল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে খাই।
ঘোমটা দাও কেন বলো তো! খেলে প্রাণখুলে খাবে, কিন্তু ততক্ষণই খাবে যতক্ষণ বুঝবে যে একা বাড়ি ফিরতে পারবে।
বোকো না।
আর একটু খাও। অল্প খেলে মজাও আসে না, শরীরেও কষ্ট হয়।
সুতরাং মন্দা আর আধপেগ নিল। আসলে সে বুঝতে পারছিল, বলুনয় এই ব্ল্যাক নাইটই তাকে আজ যা কিছু সঙ্গ দিচ্ছে।
আমি কি বুড়িয়ে যাচ্ছি বলু?
বলু খুব হাসে। হোঃ হোঃ করে। বলে, আমি নষ্ট তো তুমি বুড়ি! বাঃ বাঃ।
মন্দা ধমক দিয়ে বলল, মাতলামি নয় বলু!
খামোক ধমকাচ্ছ ভাই। মাতাল বনে কোন বেওকুফ? আমাকে গিয়ে এখন দুটো ট্রাকের তদারকি করতে হবে। আজ রাতে রওনা করিয়ে দিয়ে তবে শান্তি। মাতাল হলে আমার চলবে? চিকেন খাচ্ছাে না? ফ্যাট হওয়ার ভয়? আরে গোস্ত খেলে ফ্যাট হয় না। দাও বরং আমাকে।
হুইস্কিটাও নাও। ভাল লাগছে না।
দেবে? আমার ডোজের বেশি হয়ে যাবে যে! তবু পয়সার মাল নষ্ট করে কী লাভ? তোমার এঁটোও বহুকাল খাই না। দাও। তিলকের কথা তুমি আজকাল আর কিছু ভাবো না, না?