ফজলুর জন্য মনটা বড় খারাপ লাগছিল। সমীরণ নিজে কখনও না খেয়ে থাকতে পারে না।
ঘড়িতে যখন প্রায় পৌনে আটটা তখন সমীরণ ওঠে। না উঠে উপায়ও নেই। সুখনের রাতের অতিথিরা দু-চারজন এসে উকিঝুকি দিয়ে যাচ্ছে। ঠেলাওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, মালের কুলি, কি দেশওয়ালি ভাই। গামছা বা কাপড়ের টুকরো পেতে ঘরময় শোবে সব। আবার ভোর ভোর কাজের ধান্ধায় বেরোবে। সারাদিন কলকাতাকে খুঁটবে, হাজারও পিপড়ে যেমন মোয়া খোঁটে।
রায়বাবুর মেয়ের বোধহয় আজ আর তাকে দরকার হবে না। রাত তত কম হল না। এই ভেবে সে অফিস থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা ফজলুর কাছে চলে আসে।
ফজলু!
ত্রিপলের তলায় আলো নেই। রাস্তার আলোও এখানে কমজোরি। শুধু দোকান-পাটের আলোয় ভিতরটা আবছা দেখা যায়। সেই অন্ধকারে একটা বিড়ির আগুন ধিইয়ে ধিইয়ে ওঠে।
ফজলু আছিস নাকি! বলে মাথা নিচু করে সমীরণ ভিতরে ঢুকে চৌকিতে বসে।
ভারী কষ্টের একটা শব্দ করে ফজলু শোয়া থেকে উঠে বসে বলে, সমীদা নাকি?
হ্যাঁ। কেমন লাগছে রে?
ভাল আর কী বলল! না খেলে বড় একঘেয়ে লাগে। খেলে সময়টা কেটে যায়।
দূর বুরবক! সময় কাটানোর জন্য লোকে খায় নাকি?
মাইরি বলছি, আমার আর তেমন কোনও কষ্ট নেই। এর আগেও তো অনশন করেছি। শুধু এই নাগাড়ে না খেয়ে থাকলে মনটা কেমন ম্যাদাটে মেরে যায়। সময় কাটে না। মালিক শালাও এল না। এবার ঠিক কোম্পানি হাতবদল হয়ে যাবে সমীদা।
তোর পেটের মধ্যে গোঁতলানো দিচ্ছে না?
প্রথম প্রথম দেয়। তারপর পিত্তিটিত্তি পড়ে কেমন অসাড় হয়ে যায় ভেতরটা। খুব জলতেষ্টা পায়। আবার জল খেলে বমিবমি লাগে।
এ ভাল হচ্ছে না রে ফজলু। চাচাকে লিখে জানাই, চাচা এসে বরং তোকে নিয়ে যাক।
নিয়ে যাবে কোথায়? ডাগর ছেলে হয়ে তো ঘরে বসে খেতে পারি না। আব্বা খাওয়াবেই বা কী? আমি যা দু’-দশ টাকা পাঠাতুম তাইতে খানিক সুসার হত।
অন্য কোম্পানি তোকে নেবে না?
অন্ধকারেও ফজলুকে বেশ কাহিল দেখাচ্ছিল। রোগা মুখে হেসে নিজের কপালটা চেপে ধরে বলল, আমার মতো এলেম নিয়ে হাজার হাজার ঘুরছে।
আরও একটু ভিতরদিকে, আরও আবছায়াতে কে যেন ককিয়ে উঠে পাশ ফিরল। বলল, ওঃ শালা উপোসি শরীরে আর কত রক্ত আছে বাবা। ছারপোকা শালারা তবু ছাড়ে না। মদনা, বিড়ি আছে?
আর একটা বিড়ি জ্বলে। লোকটা বিড়ি ধরিয়ে বলে, দাদা কি খবরের কাগজের লোক?
সমীরণ বলে, না।
লোকটা বলে, খবরের কাগজে আমরা চিঠি দিয়ে এসেছি। তবু আমাদের অনশনের খবরটা ছাপছে না কেন বলুন তো? মিনিস্টার বা এম এল এ-ও কেউ এল না।
ফজলু মাথাটা টিপে রেখেই বলে, অমন কত অনশন করছে লোক, ক’জায়গায় যাবে?
সমীরণ লক্ষ করল, এদের সকলের কথাতেই একটু খোনাসুর এসে গেছে। অনেকটা ভূতের স্বরের মতো।
রাস্তা দিয়ে কিছু লোক শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল করে আসছে। বলছে, রুবি আয়রন ফাউন্ড্রির শ্রমিক আন্দোলন জিন্দাবাদ। বে-আইনি ‘টাই চলবে না। শ্রমিক ঐক্য জিন্দাবাদ। কারখানা হাতবদলের চক্রান্ত ব্যর্থ করো।
মিছিলটা বড় নয়। রোগাভোগা দরিদ্র চেহারার জনা ত্রিশ লোক। লাল শালুর ফেস্টুন তাদের হাতে। তাতে লেখা স্বস্তিকা লক কোম্পানি শ্রমিক সংঘ। তারা এসে ফজলুদের ত্রিপলের বাইরে জড়ো হল। একজন ধুতি আর শার্ট পরা লোক মাঝখানে দাঁড়িয়ে চড়া গলায় হাতের মুঠো তুলে তুলে বলতে লাগল, রুবি আয়রন ফাউন্ড্রির শ্রমিক ভাইয়েদের আন্দোলন সারা ভারতের শ্রমিকদের আন্দোলন। পুঁজিবাদ ও ধনতন্ত্রের শিকার ভারতের শ্রমিকরা এ লড়াইতে মদত দেবে…ইত্যাদি।
সমীরণ অস্বস্তি বোধ করে। কারণ, তার বেরোবার রাস্তা বন্ধ। যতক্ষণ না ওদের বক্তৃতা শেষ হয় ততক্ষণ এইখানে আটক থাকতে হবে তাকে।
অন্ধকার থেকে একটা লোক সামান্য খুশির গলায় বলল, এতক্ষণে সব আসতে লেগেছে। বিড়ি-ফেঁাকা লোকটা বলে, কাল আরও আসবে। খবরটা রটেছে। কিন্তু খবরের কাগজওলারা খবরটা স্রেফ চেপে গেল।
শেষ পর্যন্ত ছাপবে।
আর মিনিস্টাররা?
আসবে। একজন ভরসা দেয়।
ফজলু খোনাসুরে বলে, সমীদা, তোমার অফিসে কিছু হয়?
না রে। আমাকেই কবে বলবে কেটে পড়তে।
ফজলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খানিকক্ষণ বক্তৃতা শুনল। তারপর বলল, মাথাটা কেমন করছে। সমীদা, আমি বরং শুয়ে শুয়ে তোমার সঙ্গে কথা কই।
কথা কওয়ার দরকার কী? চুপচাপ শুয়ে থাক। বিড়ি-টিড়ি কিছু খাবি?
ফজলু হেসে বলে, যাঃ, তোমার সামনে খাই নাকি?
ওসব দেশের ভাই, পাড়ার দাদা সম্পর্ক রাখ তো! বিড়ি খেলে যদি শরীরটা ভাল লাগে বুঝিস তবে খা। আমি বরং মুখ ফিরিয়ে বসি।
তাই বসে সমীরণ। ফজলু বিড়ি ধরায়।
সমীরণ বসে বসে ভাবে, সে যে ভূতের ভয় পায় তা এমনি নয়। কলকাতায় আসার পর থেকেই তার ভিতরটায় নানারকম ভূত উকিঝুকি দেয়। তার মধ্যে সবচেয়ে পাজি ভূত হল চাকরি যাওয়ার ভয়। কাজকর্ম কিছু নেই, কবে যে রায়বাবু কেটে পড়তে বলবেন!
সমীরণ ভাবে, এবার থেকে যেমন করেই হোক কাজ দেখাতে হবে।
.
শেষ পর্যন্ত বলু। একটা শেষ চেষ্টা করতে বলুর গ্যারেজে ফোন করেছিল মন্দা।
ফোনটা গমগম করে উঠে প্রায় মন্দার কানের পর্দা ফাটিয়ে দিল, মন? আরে মন, তুমি তো স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছো।… যেতে বলছ? আর বোললা না, হরিয়ানা থেকে আমার চারটে ট্রাক এল এইমাত্র। গৌহাটি যাবে। দুটোর টায়ার পাংচার।…টায়ারের দাম জানো মন?