জানো না? ন্যাকা কোথাকার!
ঠোঁট উল্টে বৌধায়ন বলে, ওঃ, ওরকম অনেকেই চায়। চাইলেই পাওয়া যায় নাকি?
জয়তী সামান্য ধারালো গলায় বলে, তুমি চাও না? তা হলে এক বাড়ি লোকের সামনে একটা কুমাবী মেয়েকে নিয়ে ঘরের দরজা দাও কেন? তোমার এথিক্স নেই?
বেশি বোকো না। বিয়ের আগে তোমারও বুধাদিত্য চাটুজ্যের সঙ্গে ফিজিক্যাল কন্ট্যাক্ট ছিল। সব জানি।
জয়তী প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলে, ছিল তো কী হয়েছে? আমরা শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেছি।
বৌধায়ন হেসে বলে, সাব্বাস। দারুণ সৎ ও সতী তো তোমরা!
মানে?
তুমি তো জানো না, বুধাদিত্য চাটুজ্যে আমেরিকায় কটা মেয়ের সঙ্গে কী কী করেছে! আর সেও জানে না বিয়ের আগে তোমারই বা ক’জন ছেলেবন্ধু ছিল। আমাকে বেশি এথিক্স দেখিয়ো না।
জয়তী বেশি ঘাঁটাল না। ঠান্ডা গলায় বলল, তোমার মনে কী আছে জানি না। তবে যদি সত্যিই নয়নাকে রিজেক্ট করতে চাও তবে এক্ষুনি তা করো। নইলে ও কিন্তু এনট্রি নিয়ে নেবে। নেবে কেন, অলরেডি নিয়েছে।
বৌধায়ন চিত হয়ে শুয়ে উদাস গলায় বলে, মেয়েদের কথা আজকাল আমি ভাবি না। আমি বাউল হয়ে যাচ্ছি। জলে নামব, জল ছিটাব, জলে সাঁতার কেটে যাব, কিন্তু বেনি ভিজাব না। নয়না পারবে না। তুমি যাও তো, ভাল করে এক কাপ চা তৈরি করো, বাবুদের বাড়ির মেয়ের মতো কোরো, বস্তির ব্র্যান্ড নয়। যাও।
জয়তী তার চুল ধরে খুব জোরে একটা মোচড় দেয়। বৌধায়ন জয়তীর পিঠে একটা চড় কষায়। বলে, কেমন?
চড়টা জোর লেগেছে। জয়তীর চোখে জল এসে যায়। করুণ স্বরে বলে, মারলে তো! আচ্ছা দেখব।
বৌধায়ন পাশ ফিরে শোয়। চোখ বুজে থাকে। জয়তী কাপ তুলে নিয়ে দুম দুম করে পা ফেলে চলে যায়।
বৌধায়ন পাশ ফিরে নরম বালিশের মধ্যে মুখ ড়ুবিয়ে দেয়, প্রাণপণে চেপে রাখে নিজেকে বালিশের মধ্যে। বিড়বিড় করে বলে, হ্যাকনীড, হ্যাকনীড, জঘন্য, কুৎসিত…
রাগটা কার ওপর তা বুঝতে পারে না সে। সব কিছুই ভয়ংকর কুৎসিত, জঘন্য, হ্যাকনীড। কেন মেয়েদের কথা বারবার বলে সবাই? ক্যাতক্যাতে কাদার মতো শরীর, একঘেয়ে ঘাটাঘাটি, চুমু খাওয়া এবং ক্লান্তিকরভাবে ভালবাসা শেষ হওয়া—এ সবের মধ্যে কী আছে? সবচেয়ে হ্যাকনীড পোশাক খুলে মেয়েদের ব্যবহার করা। তবে ভাল কী? কিছু নয়। সবচেয়ে কুৎসিত এই পা ভেঙে পড়ে থাকা। নয় নম্বর বাস থেকে একটা লোক ঝুলছিল হাতল ধরে। এমন কেড়ে ঝুলছিল, এত অসহায় আর নশ্বর লাগছিল লোকটাকে যে বৌধায়ন দৌড়ে গিয়ে তাকে বাসের মধ্যে গুঁজে দিতে চেষ্টা করে। আর সেইসময়ে বাসটা তাকে চিমটি দিয়ে ধরে খানিকদূর হেঁচড়ে নিয়ে যায়। প্রথম তার মনে হয়েছিল, বাসটাই তাকে চেপে ধবেছে, পরে বুঝল আসলে পাদানির ভিড়ের ভিতরে তার হাত ঢুকে গিয়ে আটকে গিয়েছিল। সেই থেকে এই অবস্থা, কিন্তু এই মুহূর্তে তার লাফিয়ে উঠে রে রে করে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। বেরিয়েই সে লাফিয়ে বাসে উঠবে, বিপ্লব করবে, খোলা মাঠের মধ্যে দৌড়ে ভোঁ হয়ে যাবে।
কাতর শব্দ করে সে আবার পাশ ফেরে। চিত হয়, কাত হয়, উপুড় হয়। কোনও ভাবেই ভাল লাগে না। মাথার কাছে টেবিলের ওপর গুচ্ছের পেপারব্যাক থ্রিলার। একটা টেনে ঠিক দু’পাতা পড়ে রেখে দিল। কলিং বেল নেই, কাউকে ডাকতে হলে চেচিয়ে ডাকতে হবে। ডাকবেই বা কাকে। মা আর বউদি বেরোল বোধহয়, ছোট বোন শিঞ্জিনী একটা গিদধরের সঙ্গে জমিয়ে নিয়েছে। এ সময়টায় দু’জনে কোথায় যেন আশনাই করতে যায়। কদাচিৎ দাদার খোঁজ নেয় সে।
আসলে তার কেউ নেই। এই ভেবে সে চুপচাপ দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে রইল।
টেলিফোনটা বাজল অনেকক্ষণ বাদে। কতক্ষণ বাদে তা সঠিক জানে না বৌধায়ন। সে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
টেলিফোনে একটা আর্ত স্বর বলে ওঠে, বৌধায়ন!
বলছি। কী হয়েছে?
আমি মন্দা, ভীষণ বিপদ!
কী বিপদ?
আঃ…আমি ভীষণ মুশকিলের মধ্যে…আসবে?
আমি? আমার তো পা ভাঙা! কোথায় তুমি?
আমার বাবার অফিসে। অনেক লোক আমাকে ঘিরে ধরেছে। দে আর গোয়িং টু…গোয়িং টু…রেপ…মলেস্ট…বৌধায়ন! কী করব?
কী বলছ মন?
এসো শিগগির! নইলে কাউকে খবর দাও। আমি…আমি…
.
০৫.
মন্দা সেই সন্ধেবেলায় টেলিফোন করেছিল, তারপর থেকে টেলিফোনের কাছে বসে বসে মাছি তাড়িয়েছে সমীরণ। দু’বার চা খেয়ে খিদে মেরেছে। তারপর সুখনকে দিয়ে একটা পোড়া ভুট্টা আনিয়ে অনেকক্ষণ ধরে প্রতিটি সুস্বাদ দানা চিবিয়ে খেয়েছে। কিন্তু কিছুই আর করার নেই। আসলে রায়বাবু আর আচার্যিবাবুর অফিসে এমনিতেও তার করার কিছু থাকে না। প্রায়দিনই চুপচাপ বসে থাকতে হয়। টেলিফোনের দুটো এক্সটেনশন আছে, একটা রায়বাবুর ঘরে, একটা আচার্যিবাবুর ঘরে। টেলিফোন এলে দুটোই বাজে। কেউ না থাকলে সমীরণ গিয়ে ফোন ধরে। ওরা কেউ না থাকায় এখন আচার্যিবাবুর ফোনটা বাইরে রাখা আছে। সে অফিসে এসে আজকাল কেবল টেলিফোন এলে জবাব দেয়। রায়বাবু আর আচার্যিবাবু থাকলে এটুকুও তার করতে হয় না।
অনেকক্ষণ বসে থেকে থেকে মাজা রসস্থ হয়ে গেল, পিঠ টনটন করতে লাগল। রায়বাবুর মেয়ের নাকি তাকে দরকার। সেটাও চাকরি মনে করে সমীরণ বসেছিল।
যখন ভুট্টা খাচ্ছিল তখনই আবার ফজলুর মুখটা মনে পড়ে গেল। আহা, ফজলুই না খেয়ে আছে। বরাবরই গরিব ছিল ওরা। একবেলা ভাত জোটে তো অন্যবেলা মুড়ি। জমিজমা যা ছিল তারও খানিকটা ইদানীং ওর বাপ বেচে দিয়েছে। ফজলু কিছুদূর লেখাপড়া শিখে কী একটু টুকুরমুকুর মেশিনপত্রের কাজ শিখল গিয়ে বহরমপুরে। তারপর বড় শহরে বড় সুযোগের আশায় কলকাতায় চলে আসে কঁাটালের গন্ধে মাছির মতো। অনেকদিন বাদে সমীরণের সঙ্গে এই আজ দেখা।