এসব কথা সে তার মাকে বরাবরই বলে। মাও খুব মন দিয়ে শোনে আর চোখ ছলছল করে ওঠে। কিন্তু সেদিন মা এক গালের পান আর এক গালে নিয়ে বলল, তোর মাথায় আবার সেই ঘুঘু ডাকছে।
ভারী রাগ হয়েছিল বৌধায়নের। বলল, আজকাল তুমি এরকম খিটখিটে হয়ে গেছ কেন বলো তো?
মা হেসে বলল, তা তুই অত ভেবে মরিস কেন? তোর বাবাও তো বলে, বুঘোটা বড় ইমপ্র্যাকটিক্যাল আর তাই ওর কোনও কাজেকর্মে মন নেই।
মায়ের এই বিশ্বাসঘাতকতায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল সে। মাকে ছাড়া আর কাকেই বা সে বলতে যাবে এসব কথা?
তবু না হয় মায়ের ব্যাপারটা সহ্য করা গিয়েছিল, কিন্তু সবচেয়ে অসহ্য বাড়ির নতুন বউটা যখন তার পিছনে লাগে। বাইরে যে ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে তা আর কারও নয়, নতুন বউ জয়তীর।
বৌধায়ন কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে তীক্ষ্ণ চোখে দরজার দিকে চেয়ে হেঁড়ে গলায় বলল, এখন এ ঘরে আসবে না বলে দিচ্ছি জয়তী!
বাইরে থেকে সরু গলা এল, আসব।
বৌধায়ন বালিশে হতাশ মাথাটা ফেলে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। এসে নিজেই লজ্জা পেয়ে দৌড়ে পালাবার পথ পাবে না।
জয়তী এ কথার পর অবশ্য ঘরে ঢুকবার সাহস পেল না, কিন্তু বাইরে থেকে বলল, ঘুঘু পাখিটা কি ডাকছে এখন?
বৌধায়ন বিড় বিড় করে বলে, ডাকলে তোমার বাবার কী?
জয়তী বাইরে থেকে বলে, চা-টা কি ফিরিয়ে নিয়ে যাব?
মাকে দিয়ে পাঠাও। তুমি আসবে না।
মাকে ডাকতে ডাকতে ঠান্ডা হয়ে যাবে যে!
যাক। তোমার লজ্জা করে না? কাঁচা বয়সের দেওরের ঘরে হুটহাট এসে ঢোকো যে বড়!
একশোবার ঢুকব।
তা হলে তোমার মনে পাপ আছে।
আমার নয়, তোমারই আছে। লজ্জা করে না বুড়ো ছেলে ঘর ভাসিয়ে পেচ্ছাব করেছ! অকাজ ঢাকতে চোখা চোখা কথা ছাড়া হচ্ছে।
বৌধায়নের কান-ফান গরম হয়ে গেল। সে বালিশটাকে দুমড়ে মাথা আর কান ঢেকে চোখ বুজে শক্ত হয়ে পড়ে রইল। ছিঃ ছিঃ। দেখেছে উঁকি দিয়ে। এইসব মেয়েদের চুলের মুঠি ধরে…।
ঠিক তার মুখটার কাছে বিছানার ওপর একটা খবরের কাগজ ঝটকা মেরে রাখল জয়তী। খবরের কাগজের বাতাসটা পর্যন্ত বৌধায়নের মুখে লাগে। খবরের কাগজের ওপর চায়ের কাপ রেখে জয়তী পায়ে করে দরজার কাছ থেকে ভাজ করা চট টেনে এনে ঘরের মেঝেয় বন্যা রোধ করার চেষ্টা করে। চটটা এখানে সেখানে টেনে নিয়ে বেড়ায়। বলে, আবার বলে মনে পাপ আছে। এ পাপটা কে করেছে শুনি। এ বাড়ির লোকগুলোও কিস্তৃত। একটা বড় কৌটো রাখতে পারে না!..তোমার অবশ্য কৌটোয় হবে না। একটা জালা দরকার।
বৌধায়ন রক্তচোখে চেয়ে বলে, গেট আউট।
চোখ রাঙাবে তো ভাঙা পা মুচড়ে দেব।
বৌধায়ন খুব হতাশার সঙ্গে উঠে বসে। তারপর হেসে বলে, আজকালকার মেয়েরা এত বেহায়া কেন বলো তো!
ভাল করলেও আজকাল লোকের গাল ওঠে না।
এঃ ভাল! নতুন নতুন সব বউই ভাল থাকে। কয়েকদিন পরই তাদের স্বরূপ বেরোয়। তাছাড়া নাচুনি মেয়েগুলোই বাজে।
জয়তী সুন্দরী নয় মোটেই। রং কালো তবে দীঘল এবং চাবুকের মতো নমনীয় তার শরীর। সে খুবই ভাল নাচত একসময়। একাডেমিতে সেই নাচ দেখেই মেজদা বুধাদিত্য কৌতূহলী হয়ে ওঠে, কমপ্লিমেন্ট পাঠায় এবং সবশেষে বিয়েও করে। নইলে মার্কিন দেশ থেকে ইনজিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি নিয়ে আসা বুধাদিত্য অনেক ভাল পাত্রী পেয়ে যেত।
জয়তী একটা কৃট কটাক্ষ হেনে বলে, নাচুনি মেয়েরা যাই হোক, তাদের পেছনে ল্যালার মতো ঘুরে বেড়ানোর লোকের অভাব নেই। তোমার নয়নাটি কী?
নয়না আমার পোষা ময়না নয়। ঠিক উড়ে যাবে।…চা-টা খুব বাজে করেছ। এই চায়েই বোঝা যায় কোন মেয়ে কতখানি অ্যারিসটোক্র্যাট। তোমার বাবা ভুখখা পার্টি নাকি জয়তী?
জয়তী খাটের একধারে বসে খুব আলতোভাবে ডান হাতখানা বৌধায়নের ডান পায়ের ওপর রাখে, মুখখানা করুণ করে বলে, জানোই তো আমি গরিবের মেয়ে!
উঃ! হাত সরিয়ে নাও।
লাগছে? কোনখানে বলো তো?…এইখানে?— বলে জয়তী ঠিক গোড়ালির কাছটায় আস্তে আস্তে চাপ বাড়ায়।
লাগছে.এই বউদি, মাইরি কী হচ্ছে…অ্যাই.আবার ডিজলোকেশন হয়ে যাবে…মাইরি মা কালীর দিব্যি লাগছে…
জয়তী হাত সরিয়ে নিয়ে ভাল মানুষের মতো তার বেণী ঠিক করতে করতে বলে, আভিজাত্য তুলে কথা বলা আর ছোটদের মুখে বড়দের নাম ধরে ডাকা আমি পছন্দ করি না।
বৌধায়নের হাতের কাপ থেকে চা চলকে পড়েছিল। সে কাপ রেখে জামা আর বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, মেজদা একদিন ঠিক বুঝতে পারবে কী ভুলটাই করেছে। এঁটো কাপটা নিয়ে কেটে পড়ো তো!
কেটে পড়ব কী গো! মা যে আমাকে পাঠাল তোমাকে একটু কম্প্যানি দিতে।
তোমার চেয়ে গোখরো সাপের কম্প্যানি ভাল।
ও বুঝেছি। তোমার ভাবের গাছে এখন ঘুঘু ডাকছে।…ঘুঘু-ঘুঘু-ঘু …তবে বেশিক্ষণ তোমাকে জ্বালাব না। আমরা বেরোচ্ছি।
বৌধায়ন মুখ বিকৃত করে বলে, বাঁচলাম।
কোথায় যাচ্ছি জানো? চিত্রাঙ্গদা। নয়না কার্ড দিয়েছে।
গো টু হেল।
তুমি কার্টসি জানো না। মেয়েদের সামনে ‘হেল’ কথাটা বলতে নেই, তোমার মেয়ে বন্ধুরা তোমাকে কী করে সহ্য করে বলো তো?
বৌধায়ন হেসে ফেলে বলে, বরং আমি ওদের কী করে সহ্য করি সেইটেই প্রশ্ন হওয়া উচিত। নয়না তোমাদের কার্ড দিল কেন বলো তো?
চোখ বড় বড় করে জয়তী বলে, শুধু কার্ড? নিত্যি এসে শাশুড়িকে মা আর শ্বশুরকে পরিষ্কার বাবা বলে ডাকছে। তোমার ঘরেও তো দবজা বন্ধ করে প্রায়ই এক-দেড় ঘণ্টা কাটায়। কী চায়