ডাক্তাররা ওইরকম ঈশ্বরের মতোই কথা বলে। কিন্তু স্পষ্টভাষী তারা নয়। গোটা চিকিৎসা পদ্ধতিটাই রহস্য রোমাঞ্চে ভরা। বৌধায়নের দৃঢ় ধারণা, তার গোড়ালির হাড় চুরমার হয়ে গেছে, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে, চামড়া কাটলে হাড়গুলো ট্যালকম পাউডারের মতো ছড়িয়ে পড়বে। গতকাল থেকে সে এক্স-রে প্লেটটা মোনালিসার ছবির মতো মনোযোগ দিয়ে দেখেছে লক্ষবার। নেগেটিভ ছবির মতো সেই গোড়ালির নকশাও বড় রহস্যময়। কিছু বুঝবার উপায় নেই। তবু তার মনে হয়েছে ছবির মধ্যে তার গোড়ালির হাড়ে বেশ কয়েকটা ফাটল আর চিড় দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ডাক্তার তা দেখেনি, বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলেছে, তেমন কিছু নয়। একটু ভুগবেন!
বৌধায়নের আতঙ্ক যায়নি। কখনও এক্স-রে প্লেট, কখনও ব্যান্ডেজে বাঁধা পায়ের দিকে সে কুট চোখে চেয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে সারা দিন।
খুব সাহসের সঙ্গে বাঁ পা মেঝেয় নামিয়ে দিল বৌধায়ন, তারপর আহত ডান পাটা খুব আস্তে আস্তে হাত দিয়ে তুলে ধরে শিশুর মতো খাটের ধারে আনল। আর তা করতে গিয়ে যেন ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছিল সে। আসলে ব্যথা লাগছিল না। ব্যথার ভয়, ব্যথার স্মৃতি।
এ বাড়িতে একজন ভারী লজ্জার মানুষ আছে। সে হল তার মেজদার বউ। নতুন বউ। সারাদিন সারা বাড়িতে ছলবল করে ঘুরে বেড়ায়, যখন তখন তার ঘরে এসে হানা দেয়, বুধবা, কেমন আছ? এঃ মা গোদা পা! বলে বসে পড়ে। মাঝে মাঝে ব্যান্ডেজের ওপর চিমটি কাটার চেষ্টা করে। ফাজিল। কিন্তু সেটা তেমন বিপজ্জনক নয়। আসল বিপদ হল নতুন বউটা যদি হুট করে তার পেচ্ছাপের সময় এসে ঘরে হাজির হয়। বৌধায়নের সাধ্য নেই উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে আসে।
বৌধায়ন আতঙ্কে আর সন্দেহে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। পাতলা পর্দা হাওয়ায় উড়ছে। জয়তী কি এই বিকেলে বাড়িতে আছে? বেরোয়নি?
কিন্তু ভাববার উপায় নেই। তলপেট ভারী হয়ে ঝুলে পড়ছে। যন্ত্রণার মতো। মেঝেয় ডান পাটা সটান করে রেখে বাঁ পায়ের ওপর হাঁটু গেড়ে বসল সে। বড্ড কষ্ট হয় বসতে এইভাবে। ব্যথা-বেদনায় ভয়ংকর বিকৃত করল মুখ। কৌটোটা মুহূর্তে ভরে উঠল ঘৃণ্য তরলে। এইবার উপচে পড়বে। পড়ল… ইস ছিঃ ছিঃ…।
ঘর ভাসিয়ে উঠে পড়ল বৌধায়ন। বাঁ হাঁটু ভিজে গেছে, ডান পায়ের ব্যান্ডেজেরও খানিকটা ভেজা। কিছু করার নেই।
বিছানায় ক্লান্ত ভাবে শুয়ে সে সিগারেট ধরায়। সারা ঘরের মেঝেয় গড়ানো তরল পদার্থের কথা ভুলবার জন্য সে একটা ভাল কিছু চিন্তা করবার চেষ্টা করতে যাচ্ছে। এতকাল সবচেয়ে প্রিয় চিন্তা ছিল কোনও একটি, যে কোনও একটি মেয়েকে নিয়ে। অজস্র মেয়ে, যখন যাকে ইচ্ছে ভাবতে পারত সে। একটু আগে মন ফোন করেছিল।
মন তো জানে না ওকে নিয়েও কত দিন ভেবেছে বৌধায়ন। পাশবালিশ আঁকড়ে ধরে মনকে ভেবে ভালবাসার চুমু দিয়েছে তুলোয়। কিন্তু সে সব চিন্তা আজকাল ফকিকারী হয়ে গেছে কেন যে! ভাল কিছু ভাবতে গেলে কিছুতেই মেয়েদের কথা মনে আসে না।
চোখ বুজলেই আজকাল সে একটা ঘোেলা জলের স্রোত দেখতে পায়। নদীটা খুব চওড়া নয়। দু’পাড়ে মাইল মাইল জুড়ে নির্জনতা আর গরান গাছ, বাবলা বন। একদিকে ভাঙা পাড়ের মাটির মধ্যে খাঁজে খাঁজে ইট। কোনও এক স্থাপত্যের ধ্বংসস্তৃপা পাখি ডাকছে। নৌকো চলেছে ধীরে, উজান ঠেলে। জোয়ারের জল তীরের ঘাসপাতা ড়ুবিয়ে ছলাৎ ছল শব্দে ভাঙছে। গোসাবার পর ওই নির্জনতা আর নির্জনতা ছাড়া কিছু নেই। সে এক গহিন প্রাকৃত জগৎ।
একবারই গিয়েছিল বৌধায়ন ওইখানে। আজকাল বার বার সেই নদীটা তার মনে পড়ে। আর খুব স্নিগ্ধ হয়ে যায় মন। কে যেন মলম মাখিয়ে দেয় তার হৃদয়ের ঘেঁড়া খোঁড়া ক্ষতস্থানে। মায়ার কাজল পরিয়ে দেয় চোখে।
পাশ ফিরে বালিশে অস্থিরভাবে কপাল ঘষে বৌধায়ন। সে কেন মেয়েদের কথা ভাবতে পারছে না? তার বদলে বরং তার হঠাৎ মনে পড়ে, সেবার শংকরের নতুন কেনা গাড়ির টায়ার ফসল ধলভূমগড় থেকে ফেরার পথে। শংকর জ্যাক লাগিয়ে চাকা বদল করছিল। স্টেপনি লাগাতে তাকে কিছুটা সাহায্য করল বৌধায়ন, তারপর চুপচাপ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে তাকিয়েছিল একটা প্রকাণ্ড পোড়ো মাঠ আর ঢেউ ঢেউ টিলার দিকে। শীতের তখন সবে শুরু। ভোরবেলা ছিল। নীল আলোয় মাখামাখি আকাশ, লুটোপুটি অঢেল নরম রোদ। মুহূর্তের মধ্যে সে যেন গলে গেল, মিশে গেল চারধারের সঙ্গে। সেই যে স্তম্ভিত মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বৌধায়ন, সেই থেকে আজও সে সেইখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনওদিনই পুরোপুরি ফিরে আসতে পারেনি। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, মনে হয়, দেখে, একটা বিশাল শালগাছের ছায়ায় সে দাঁড়িয়ে, চারদিকে ঢাউস ঘুড়ির মতো বড় বড় পাতা খসে পড়ছে শীতের বাতাসে, আর আলোর পুকুর থেকে উঠে আসছে পৃথিবীর টিলার ঢেউ, আর অকাজের পোড়ো মাঠ চিত হয়ে শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে।
বাইরের বারান্দা থেকে একটা নকল ঘুঘুর ডাক শোনা গেল! উৎকর্ণ হয়ে শুনল বৌধায়ন। তারপর সভয়ে চেয়ে রইল ঘরের মেঝের দিকে। ওপচানো ঘৃণ্য তরলে থই থই।
একটু ভাবুক বলে বন্ধুরা তার খ্যাপানো নাম দিয়েছে, ভাবের ঘুঘু। বৌধায়নের এই নামটা কী করে যে তার বাড়িতেও জানাজানি হয়ে গেছে কে জানে। পা ভাঙার পর লম্বা একঘেয়ে দুপুরে মাঝে মাঝে তাকে সঙ্গ দিতে মা এসে পাশে শুয়ে থাকে। কদিন আগে দুপুরবেলায় সে শুয়ে শুয়ে মাকে বলছিল, জানো মা, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আর জন্মে আমি ছিলাম লেবুগাছ। এই যে আমার হাত দেখছ, পা দেখছ, এসব ছিল ডালপালা, আর এই কনুই কবজি, কণ্ঠা, বুক পিঠ ছিল তাজস্র কাটা। কান নাক হাতে, তেলো ছিল সবুজ সুগন্ধী পাতায় ছাওয়া। তখন আমার শরীর জুড়ে সাদা সুঘ্রাণ ফুল ফুটত। আর ফুল ঝরে গিয়ে কচি কচি সবুজ তাজা লেবু ফলত। মনে হয় কী জানো? মনে হয়, আমি যখন লেবু গাছ ছিলাম তখন তুমি ছিলে এত্তোটুকু ফুটফুটে একটা মেয়ে, আর বোজ গিয়ে লেবু ছিড়তে আমার ডালপালা থেকে। আমার খুব দুঃখ ছিল যে আমার ঘর নেই, দালান নেই, শীতে গ্রীষ্মে বর্ষায় রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এক জায়গায়, কোথাও যাওয়ার জো নেই। আর তখনই তোমাকে দেখে আমি মনে মনে ভাবতাম, এবার একদিন আমি মরে যাব। তখন এই ফুটফুটে মেয়েটার বিয়ে হবে আর আমি ওর কোলে আসব ছেলে হয়ে।