চিঠি নিয়ে আবার হইচই লাগল। মামা-মামিরা পিপুলকেই বিদায় করার পক্ষে। দিদিমার মত হল, হাতচিঠি পেয়েই অচেনা মানুষের হাতে নাতিকে ছেড়ে দিতে পারব না। তাতে যা হয় হোক।
কালীমামা লাফাতে লাগল, ছাড়বে না মানে? পরের ছেলে আটকে রেখে জেল খাটব নাকি সবাই?
জেল হলে আমার হবে, তোদের কী? পুলিশ এলে আমাকে ধরিয়ে দিস। এই বলে দিদিমা পিপুলকে কাছে টেনে ধরে রইল, পাছে ওকে কেড়ে নেয় ওরা।
হরিমামা কালীমামার মতো লাফালাফি করে না। সে মিটমিটে মানুষ। খুব মোলায়েম গলায় বলল, এখানেই বা ওকে কোন আদরে রেখেছি আমরা বলো! নিজের বাপের কাছে ওর তবু দাম আছে। যেমনই লোক হোক, ছেলেকে তো আর ফেলবে না।
যে লোকটা চিঠি নিয়ে এসেছে তাকে চেনে না পিপুল। তবে চেহারা দেখে মনে হয়, লোকটা সুবিধের নয়। রোগা, রগ-ওঠা চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখদুটো বেশ লাল। সে প্রথমটায় কথা বলছিল না, এবার এসব শুনে বলল, কাজটা খুব খারাপ করছেন আপনারা। হরিশচন্দ্রকে আপনারা মারধর করেছেন, তার জন্য খেসারত আছে। আবার ছেলেকে আটকে রাখছেন, এর জন্য দুনো খেসারত।
কালীমামা তিড়িং-বিড়িং করে উঠে বলল, কীসের খেসারত? হরিশচন্দ্র যা করেছে তাতে তার ফাঁসি হয়। আমাদের হাতে সে শুধু ঠ্যাঙানি খেয়ে বেঁচে গেছে। আর ছেলে? ছেলেকে তো সে-ই আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে গেছে। তৈরি ছেলে, চুরি-চামারিতে পাকা হাত। অতি শয়তান।
লোকটা বারান্দায় ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসা, বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে বলল, মারধর বাবদ পাঁচটি হাজার টাকা গুনে না দিলে হরিশচন্দ্র আপনাদের শ্রীঘর ঘোরাবে, এই বলে রাখলুম। এ তল্লাটের মেলা সাক্ষী জোগাড় হয়ে গেছে। পুলিশেও সব জানানো হয়েছে। তবে মোকদ্দমায় না গিয়ে আপসে হয়ে গেলে হরিশচন্দ্র ঝামেলা করবে না। ওই পাঁচটি হাজার টাকা আর ছেলের সঙ্গে ওর মায়ের গয়নাগুলোও দেবেন। না হোক বিশ ভরি সোনা, কম কথা তো নয়।
কালী আর হরি একথা শুনে এত চেঁচাতে লাগল যে, অন্য কেউ হলে ভয় খেত। এ লোকটা পোক্ত লোক। পাকা বাঁশের মতো পোক্ত। একটুও ঘাবড়াল না। বলল, আমার হাতে টাকাটা না দেন, হরিশচন্দ্রর হাতেই দেবেন। সে স্টেশনে লোকজন নিয়ে অপেক্ষা করছে।
তবে রে! বলে কালীপদ তখনই স্টেশনে যাওয়ার জন্য ছুটে বেরোতে যাচ্ছিল।
হরিপদ তাকে আটকাল। বলল, আর ও কাজ করতে যাসনি। এবার বিপদ হবে। বরং দল বেঁধে গিয়ে আপসে কথা বলে আসাই ভালো।
লোকটা মিটিমিটি হাসছিল। বলল, আমাকে আপনারা চেনেন না। আমি হলুম শ্রীপদ মন্ডল। শ্রীরামপুর শহরে যে কাউকে নামটা একবার বলে দেখবেন, কপালে হাত ঠেকাবে। এটা আমার এলাকা নয় বটে, কিন্তু এ জায়গাতেও আমার যাতায়াত আছে। রেসো, নন্দু, কোকা সব আমার বন্ধু-মানুষ। আপনারাও নাম শুনে থাকবেন।
নাম সবাই শুনেছে। রেসো, নন্দু আর কোকা এ অঞ্চলের ষন্ডাগুন্ডা। কালীপদর মুখখানা যেন কেমন হয়ে গেল। কথা ফুটল না মুখে। তবে রাগে কাঁপছিল।
লোকটা তার দিকে চেয়ে বলে, এবার সুবিধে হবে না আপনার!
লোকটা কালীপদর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসিটি বজায় রেখেই বলল, আপনার এখন জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ।
কালীপদ হুংকার দিতে গিয়েছিল, হল না। গলাটা ফেঁসে গিয়ে মিয়োনো আওয়াজ বেরোল, তার মানে?
পুলিশে যদি কিছু না করে তাহলে আমি করব।
কী করবে?
ঘাড় নামিয়ে দেব। এই আপনার বাড়িতে বসেই বলে যাচ্ছি, টাকাপয়সা দিয়ে যদি মিটমাট না করেন, গয়না যদি ফেরত না দেন, তাহলে খুব বিপদ হয়ে যাবে।
কালীমামা ফের একটু তড়পানোর চেষ্টা করে বলল, মগের মুলুক পেয়েছ? বাড়ি বয়ে এসে চোখ রাঙানো, অ্যাঁ?
শ্রীপদ মন্ডল যে আত্মবিশ্বাসী লোক তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল এবার। মগজটি ঠাণ্ডা, মুখে একটা হাসির ভাব আছেই, কথাবার্তায় তেমন কিছু গরম নেই, গলাটি এবারও তুলল না। বলল, মশাই, আপনার তো কেবল তর্জন-গর্জনই দেখছি। আমি যা বলেছি সেটা একটু ঠাণ্ডা মাথায় বসে বিবেচনা করুন, তারপর আপনার যা ইচ্ছে করবেন। কিন্তু আমি যা বলি তা কাজেও করি, কখনো নড়চড় হয় না।
একথায় কালীমামার মুখে কুলুপ পড়ল। তার জায়গা নিল হরিমামা। বেশ মোলায়েম গলায় হরিমামা বলল, আমার দাদার মাথাটি কিছু গরম, নইলে লোক খুব খারাপ নন। তা হরিশচন্দ্র একটা দাঁও মারতে চাইছে তাহলে! বলি কাজটা কী তার উচিত হচ্ছে? শত হলেও জামাই মানুষ, একরকম আত্মীয়ই তো?
শ্রীপদ মন্ডল ঠাণ্ডা গলায় বলল, সেটা আপনারা মনে রাখলেই ভালো হয়। আত্মীয় বলেই যদি বিবেচনা হয়ে থাকে তাহলে আত্মীয়কে কেউ লোক জুটিয়ে হাটুরে কিল দিয়ে হাসপাতালে পাঠায় নাকি!
সে যা হয়ে গেছে, গেছেই। মানুষ তো ভুল করেই। তবে কিনা আমাদের বোনটাকে ওভাবে খুন করাটাও তো হরিশচন্দ্রের ঠিক কাজ হয়নি।
খুন বলে প্রমাণ করতে পেরেছেন কি?
প্রমাণ করতে পারলে কী আর হাত গুটিয়ে বসে আছি রে ভাই! সে তো আর কাঁচা খুনী নয়। সব দিক বেঁধেছেঁদে কাজটি ফর্সা করেছে। সে বাবদে তো তার কাছ থেকে আমরা কানাকড়িটিও চাইনি। চেয়েছি, বলো?
এবার কী চাইতে ইচ্ছে করছে?
হরিপদ একটু হাসল। বলল, গয়নাগাটি আমাদের কাছে পাচার করবেটা কে? আমার বোনকে তো সে বাপের বাড়িতে আসতেও দিত না। ওই গয়না একটি একটি করে নিয়ে বন্ধক রেখে রোজ ফুর্তি করত। খুনটাও সেই গয়নার বাবদেই কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।