আজকাল সকালের দিকে জানালার ধারে একটা বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। ছবি আঁকার সময় কেউ চেয়ে থাকলে রণেশের কাজ এগোতে চায় না, অস্বস্তি হয়। তাই প্রথম দিন অ্যাই পালা বলে ধমকে দিয়েছিল। ছেলেটা কয়েকদিন আসেনি। দিনসাতেক বাদে আবার ছেলেটার কৌতূহলী মুখ জানালার দেখে রণেশ অবাক হয়ে বলল, কি চাস বল তো!
ছবি দেখছি।
ছবি দেখতে ভালো লাগে?
হ্যাঁ।
আঁকতে পারিস?
না তো!
রণেশ সেদিন ছেলেটাকে তাড়াল না, শুধু বলল, জানালার পাল্লার ওদিকটায় সরে দাঁড়া, নইলে তোর ছায়া এসে ছবিতে পড়বে।
ছেলেটা সন্তর্পণে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছবি আঁকা দেখল।
আজকাল প্রায়ই আসে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। তারপর চলে যায়।
ছবি নিয়ে মস্ত জুয়া খেলেছিল রণেশ। চাকরি বা ব্যবসা না করে শুধু ছবি এঁকে সংসার চালানোর ঝুঁকি নিয়েছিল। বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও। কিছুদিন খুব কষ্ট গেছে। তবে তার ভাগ্য ভালো, সে নাম করল এবং বাজার পেল অত্যন্ত দ্রুত। কলকাতায় তার নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে, স্টুডিয়ো আছে। তবু কলকাতা থেকে একটু দূরে নিরুপদ্রবে নিরবচ্ছিন্ন ছবি আঁকার জন্য সে এখানে একটা বাড়ি কিনে নিয়েছে। এখানে সে বেশির ভাগ সময়েই একা থাকে, একজন কাজের লোক তার রান্নাবান্না সব করে দেয়। মাঝে মাঝে তার বউ-বাচ্চারা আসে এবং কয়েকদিন করে থেকে যায়।
রণেশ কয়েকদিন দেখার পর একদিন ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে, তোর নাম কি?
পিপুল ঘোষ।
কোন বাড়ির ছেলে তুই?
ওই রায় বাড়িতে থাকি। ওটা আমার মামাবাড়ি।
রায় বাড়ি? ওখানে তো খুব গন্ডগোল হয়েছিল কয়েকদিন আগে, তাই না?
হ্যাঁ।
তোর কে আছে?
শুধু বাবা, দাদু আর কাকিমা। মা নেই।
ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে?
পারি না যে।
কাল একটা কিছু এঁকে নিয়ে আসিস তো, দেখব। একটা কথা বলে দিই, কোনো ছবি দেখে নকল করিস না কিন্তু। যত খারাপ হোক মন থেকে আঁকবি।
পরদিন পিপুল একটা সাদা পাতায় পেনসিলে আঁকা যে ছবিটা নিয়ে এল তা একটা উড়ন্ত কাকের ছবি। বেশ ভালোই এঁকেছে। রণেশ খুশি হয়ে বলে, ছবির নেশা দেখেই বুঝেছি তোর ভেতরে আর্ট আছে। ঘরে আয়। ওধারে চুপটি করে বসে আঁকা দেখ। শব্দ করিস না।
শব্দ করেনি পিপুল। ছবির রাজ্যে কোনো শব্দ নেই, কোলাহল নেই। শুধু রূপের জগৎ খুলে যায় চোখের সামনে। নির্জন শব্দহীন ঘরে একটা বাচ্চা ছেলে যে খেলাধুলো দুষ্টুমি ভুলে চুপ করে বসে থাকতে পারে এটা একটা সুলক্ষণ।
রণেশ ছবি আঁকতে আঁকতে মাঝে মাঝে কফি বানিয়ে খায়, কখনো-বা পায়চারি করে, কখনো চোখ বুজে চুপ করে বসে থাকে। মাঝে মাঝে নিরবচ্ছিন্ন ছবি আঁকায় একটু-আধটু ফাঁক দিতে হয়।
এরকমই একটা ব্রেক নিয়ে আজ রণেশ ছেলেটার মুখোমুখি বসল। ছেলেটি বাচ্চা হলেও এই বয়সেই এর জীবন বেশ ঘটনাবহুল। সব মন দিয়ে শুনল রণেশ। ছেলেটা বড্ড গন্ডগোলে পড়েছে। বাবা হাসপাতালে, অস্তিত্ব অনিশ্চিত।
রণেশ জিজ্ঞেস করে, ইস্কুলে ভরতি হোসনি?
উদাস মুখে পিপুল বলে, মামারা কী আর পড়াবে!
পড়াবে না কেন?
আমার এখানে থাকাটাই তো পছন্দ করছে না। তাড়াতে চাইছে।
আমি যদি তোর স্কুলের খরচ দিই?
তাহলে পড়ব।
আরও বলে দিই, যদি ও বাড়ি থেকে তোকে তাড়ায়, তাহলে আমার কাছে এসে থাকতে পারিস। এ বাড়িতে তো জায়গায় অভাব নেই।
পিপুল এ কথায় খুশি হল। বলল, আমাকে থাকতে দেবেন? চুরি করব বলে ভয় পাবেন না তো?
রণেশ হাসল, এ বাড়িতে চুরি করার মতো কিছুই থাকে না। একমাত্র রং, তুলি আর ক্যানভাস ছাড়া। আর তোকে চোর বলে মনে হয়নি আমার। ওসব ভাবিস কেন!
পিপুল অবশ্য থাকল না। রণেশ তার স্কুলে ভর্তির টাকা দিল আর বই-খাতার খরচ। ছবি আঁকার কিছু সরঞ্জম দিয়ে বলল, খবর্দার, ছবি আঁকতে গিয়ে পড়াশুনোয় ফাঁকি দিস না, তাহলে কিন্তু দুটোই যাবে।
পিপুলের জীবন এইভাবে শুরু হল, নানা গন্ডগোলে, কিন্তু থেমে রইল না। রণেশ ছবি আঁকে বলেই বাস্তব জগতের অনেক কিছু মাথায় রাখতে পারে না। কিন্তু পিপুলের মুখ দেখে সে ঠিক বুঝতে পারে কবে এর খাওয়া হয়নি, কবে এ মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে বা মারধর খেয়েছে।
মামাবাড়িতে পিপুলের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। দাদু আর দিদিমা তাকে আগলে রাখে বটে, কিন্তু তারা সব কিছু ঠেকাতে পারে না। মামারা নানাভাবে তাকে উৎখাত করতে চাইছে। বড় কারণ হল, এখনকার আইনে মামাবাড়িতে পিপুলের মায়েরও অংশ আছে। সুতরাং পিপুল যদি একদিন দাবি করে তাহলে বাড়ি আর সম্পত্তির অংশ তাকে দিতে হবে। তাছাড়া আছে তার মা আশালতার বেশ কিছু গয়না। আশালতা গলায় দড়ি দেওয়ার আগে সব গয়না তার মায়ের কাছে গচ্ছিত রেখে যায়। সে খবর মামা-মামিরা জানে। তক্কে তক্কে ছিল সবাই, সে সব গয়না ভাগজোখ করে নেবে। পিপুল মস্ত দাবিদার।
সে আসার পরে মামাবাড়িতে গন্ডগোল ঝগড়াঝাঁটি অনেক বেড়ে গেছে। সকলেরই লক্ষ্য হল দিদিমা আর দাদু। উপলক্ষ পিপুল। দাদু চুপচাপ মানুষ। দিদিমা কিছু বলিয়ে কইয়ে। কিন্তু মামা-মামিদের সমবেত ঝগড়ার সামনে দাঁড়াতে পারবে কেন? ভালোর মধ্যে শুধু পিপুলের গায়ে আর কেউ হাত তোলেনি।
প্রায় ছ-মাস বাদে এক সকালে পিপুলের বাবা হরিশচন্দ্র ঘোষের একটা হাতচিঠি নিয়ে একজন লোক এল। তাতে লেখা, পত্রপাঠ এই লোকটির সঙ্গে আমার ছেলেকে ফেরত পাঠাবেন। নইলে মামলা করব।