হ্যাঁ। কাল রাতে খুব জ্বর এসেছিল। আজ সকালে ছেড়েছে।
ঝিকু কুয়োতলা থেকে বলল, ইস মাগো! কী মার মেরেছে দেখো! সারা গায়ে কালশিটে –তোমরা মানুষ না কী গো!
লোকটা খুব কড়া চোখে তাকে দেখছিল। মুখখানাও চোয়াড়ে। যেন জীবনে কখনো হাসেনি। বলল, লম্পট আর মাতালের ছেলে–কত আর ভালো হবি। একটা সত্যি কথা কবুল করবি? তোর মাকে তোর বাবা খুন করেনি?
না, মা তো গলায় দড়ি দিয়েছিল।
সে তো গপ্পো। গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে দড়িতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। বল তো সত্যি কি না?
পিপুলের চোখে জল এল। মা! মা থাকলে দুনিয়াটা কী এরকম হত? এত মারতে, অপমান করতে পারত কেউ?
সত্যি কথা তোর মুখে আসবে না জানি। এবার বল তো, তোর বাবা তোকে কেন এ বাড়িতে ঢুকিয়ে নিজে আড়ালে লুকিয়ে বসেছিল?
ঝিকু বালতিতে জল তুলতে তুলতে বলল, ওসব কথা তুলছ কেন? মশা মারতে তো কামান দেগে বসে আছ! চারদিকে তোমাদের নিয়ে কথা হচ্ছে! ছেলেটাকে মেরেছ, বাপটাকে প্রায় খুন করে ফেলেছ–কোমরে দড়ি পড়ল বলে।
তুই চুপ করবি?
ঝিকু মাঝবয়সি মজবুত চেহারার মহিলা। গায়ের রং ঘোর কালো, দাঁত উঁচু, কপালে আর সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর। হঠাৎ চোখ পাকিয়ে বলল, আমাকে অত চোখ রাঙিও না। মাসকাবারে চল্লিশটা টাকা দাও বলে মাথা কিনে নাওনি!
এ কথায় লোকটা একটু মিইয়ে গেল যেন। বলল, তুই ঘরে যা। আমি আসছি। পিপুল ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে ঘরে এসে খাটে বসে রইল। তার দুর্গতি যে কেন শেষ হচ্ছে না তা সে বুঝতে পারছে না।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে লোকটা হাতে এক কাপ গরম চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। কাঠের চেয়ারটায় জুত করে বসে বলল, দিদিমার খুব আশকারা পাচ্ছিস, না?
পিপুল কিছু বলল না, চেয়ে রইল।
কাল অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের রাগ এখনও যায়নি।
পিপুল একটু সাহস করে হঠাৎ বলল, আমি তো কিছু করিনি।
আলবাত করেছিস। তোকে দিয়ে তোর বাপ কিছু করাতে চেয়েছিল। নইলে তার এত সাহস হয় না যে এ তল্লাটে আসবে!
সেটা আমার বাবা জানে।
তুইও জানিস। পেট থেকে কথা বার কর ভালো চাইলে।
কে জানে কেন, হঠাৎ পিপুলের একটু সাহস এল। সে হঠাৎ লোকটার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, আপনারা আমার বাবাকে কেন মেরেছেন? আমাকে কেন মেরেছেন? মারলেই হল!
লোকটা ভীষণ অবাক হয়ে গেল। চমকে যাওয়ায় চা-ও খানিক চলকে পড়ল। খানিকক্ষণ কথা বলতে পারল না।
পিপুলের সাংঘাতিক রাগ হল এবার। লাফ দিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে সে বিকট গলায় বলল, আপনারা ভীষণ খারাপ লোক। খুব খারাপ লোক।
আমরা খারাপ লোক! বলে লোকটা হাঁ করে রইল। তারপর হঠাৎ উঠবার একটা চেষ্টা করে বলল, তবে রে! তোর এত সাহস!
কী হল কে জানে, লোকটা উঠতে গিয়ে প্রথমে চেয়ারটা ফেলল দড়াম করে, তারপর চা সামলাতে গিয়ে নিজেও টাল খেয়ে একেবারে চিৎ হয়ে পড়ে গেল মেঝের ওপর। চায়ের কাপ ডিশ ভাঙল ঝনঝন করে। এই কান্ড দেখে ঠাণ্ডা হয়ে গেল পিপুল। সে কিছু করেনি।
লোকটা উঃ আঃ করে কাতর শব্দ করছিল। বিকট শব্দে নীচের তলা থেকে দুটি বউ, একজন পুরুষ কী হল, কী হল বলতে বলতে উঠে এল ওপরে। লোকটি সেই ভয়ঙ্কর কালীমামা।
লোকটি কোমর ধরে অতিকষ্টে উঠে বসে বলল, ওফ, মাজাটা গেছে।
কালীপদ চোখ পাকিয়ে বলল, এই ছোঁড়া তোকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল বুঝি?
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, না না, ও ফেলেনি। চেয়ারটা উলটে পড়ে গেল হঠাৎ।
লোকটা দাঁড়িয়ে মাজায় হাত বোলাতে লাগল।
কালীমামা একবার বিষদৃষ্টিতে পিপুলের দিকে চেয়ে নীচে নেমে গেল। বউ দুটোও ভাঙা কাপ ডিশ কুড়িয়ে মেঝের চা ন্যাকড়ায় মুছে নিয়ে চলে যাওয়ার পর চোয়াড়ে লোকটা হঠাৎ পিপুলের দিকে চেয়ে একটু হাসল। ঝকঝকে মজবুত দাঁত, আর হাসলে চোয়াড়ে মুখটাকে বেশ ভালোই দেখায়। লোকটা চেয়ারে বসে বলল, অমন রাগিয়ে দিতে আছে।
পিপুল কথাটার জবাব খুঁজে পেল না।
লোকটা মাঝে মাঝে কাতর শব্দ করছে। তার মধ্যেই বলল, আমি তোর সেজো মামা, বুঝলি?
পিপুল ঘাড় নাড়ে–বুঝেছি।
তা এখানেই বুঝি তোর থানা গাড়ার মতলব?
পিপুল মাথা নেড়ে বলে, না। আমি বাড়ি যাব।
হরিপদ তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে একটু চেয়ে থেকে বলে, বাড়ি যাবি? তার তত লক্ষণ দেখছি না! মা আর বাবা তো দেখছি নাতি পেয়ে হাতে চাঁদ পেয়েছে।
আমি বাড়ি যাব।
কেন, এ জায়গাটা কি খারাপ?
আমার ভালো লাগছে না।
হরিপদ এবার বেশ খুশিমনে একখানা হাসি হাসল, ওরে শোন বোকা, তেতো দিয়ে শুরু হলে খাওয়াটা শেষ অবধি ভালোই হয়। উত্তম মধ্যম খেয়ে শুরু করেছিস, তোর বউনি ভালোই হয়েছে। যতটা খারাপ ভাবছিস আমরা ততটা খারাপ নই। মেজদা একটু রাগচটা গুন্ডা লোক বটে। একটু সামলে থাকলেই হল। আমার দু-খানা ঘর আছে নীচে, আরামে থাকবি। ইস্কুলে ভরতি করে দেবখন। আমার বাচ্চাটাকে একটু রাখবি আর ফাইফরমাশ খাটবি একটু। পারবি না? বাড়ি গিয়ে কোন কচুপোড়া হবে?
পিপুল ছেলেমানুষ হলেও বোকা নয়। সে বুঝল, এ লোক ধড়িবাজ। তাকে বিনি-মাগনা চাকর রাখতে চায়। সে মাথা নেড়ে বলে, থাকলে দিদিমার কাছে থাকবে, আর কারো কাছে নয়।
আচ্ছা এখন জিরো, পরে দেখা যাবে।
এই বলে হরিপদ ক্যাকাতে ক্যাকাতে একটু নেংচে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
২. রণেশ ছবি আঁকে
রণেশ নীচের তলার ঘরে বসে ছবি আঁকে। বাঁ দিকের জানালা দিয়ে আলো আসে। জানালার পাশে একটু পোড়ো জমি। তার ওপাশে রাস্তা। জানালার ধারে একটা আতা গাছ আছে। আতা গাছ রণেশের খুব প্রিয়। ভারি সুন্দর এ গাছের পাতা। পৃথিবীর দৃশ্যমান যা কিছু সুন্দর তাই তার প্রিয়। সুন্দরের কোনো অভাব পৃথিবীতে মোটেই নেই। চারদিকে মনোযোগী চোখ ফেললে কত সুন্দরের দেখা পাওয়া যায়। রণেশের চোখে স্থায়ী এক রূপমুগ্ধতা আছে।