আমার বড়ো ভয় করছে যে দিদিমা।
ভয় তো আমাদেরও করে। উমাপদমামাকে মনে আছে তোর?
না, আমার কাউকে মনে নেই।
না থাকারই কথা। আমার বড়ো ছেলে হল উমাপদ। সে ততটা খারাপ নয়, তবে ভাইদের অত্যাচারে সেও তিষ্ঠোতে পারেনি। স্টেশনের কাছে একখানা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। বিউটি বিচ্ছু হলেও উমাপদ কিন্তু ভালো। তার কাছে থাকবি?
পিপুল মাথা নেড়ে বলে, আমি এখানে থাকব না, বাড়ি যাব।
বাড়িতেও তার আদর নেই বটে, কিন্তু সেখানে অবস্থা এতটা খারাপ নয়। মামাবাড়িতে এসে তার মনে হচ্ছে, তাদের চেয়েও ঢের ঢের খারাপ অবস্থায় লোকে দিব্যি আছে। বাড়ি তার চেনা জায়গা। বাড়িতে আদর না থাক, পাড়াভরতি, স্কুলভরতি তার কত বন্ধু। পালিয়ে থাকার কত জায়গা।
দিদিমা আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই যদি যাবি ভাই, তবে তাই যাস। উমাপদ গিয়ে দিয়ে আসবেখন। ওদিকে তো আর এক সর্বনাশের কথা শুনছি! জামাইকে মেরে পাটপাট করেছে, পুলিশ আসতে পারে!
বাবার সঙ্গে পিপুলের তেমন ভাবসাব নেই। তেমন টানও নেই বাবার ওপর। তবু একটু কষ্ট হচ্ছিল বাবার জন্য। মামাবাড়িটা যে ভারি বিপদের জায়গা আর কালীমামা যে সাংঘাতিক লোক এটা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
দিদিমা বাসি রুটি আর গুড় এনে দিল। সকাল বেলায় সে রাক্ষুসে খিদে টের পাচ্ছিল। পেট ভরে খেল। শরীরে হাজারো ব্যথা, ভীষণ দুর্বল। খাবারটুকু খেয়ে শরীরে যেন একটু জোর পেল।
দিদিমা সাবধান করে দিয়ে বলল, আমার ওদিকে অনেক কাজ। তোর দাদু গেছে এজমালি পুকুরে, সেখানে আজ মাছের বাঁটোয়ারা হবে। তোর ঘর থেকে বেশি বেরোনোর দরকার নেই। চুপচাপ পড়ে থাক বিছানায়। ওরা ধরে নেবে তোর এখনও অসুখ।
দিদিমা দরজা ভেজিয়ে চলে যাওয়ার পর খানিকক্ষণ সত্যিই মটকা মেরে পড়ে রইল পিপুল। কিন্তু সে নিতান্তই বালক। তার পক্ষে এভাবে অসময়ে শুয়ে থাকা তো সম্ভব নয়। সে ছটফট করছে, বারবার উঠে বসছে। পেচ্ছাপ পেয়ে রয়েছে অনেকক্ষণ, কিন্তু কোথায় সেটা করা যায় তা বুঝতে পারছে না।
দিদিমা আর এ ঘরে আসছে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে আর না পেরে ভেজানো দরজা খুলে বেরিয়ে এল বিপুল। লম্বা দরদালান হাঁ-হাঁ করছে ফাঁকা। কিন্তু কোনোদিকে কোনো কলঘর নেই। পেচ্ছাপ পাওয়াটাই একটা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল পিপুলের কাছে। দরদালানের জানালা দিয়ে সাবধানে উঁকি দিয়ে সে দিদিমাকে খুঁজল। নীচে বড়ো উঠোন। কুয়োতলায় দু-জন ঝি বাসন মাজছে, একজন লুঙ্গিপরা লোক দাঁতন করছে পেয়ারাতলায় দাঁড়িয়ে। পিছনদিকে গোয়ালঘরের সামনে দুটো গোরু মাটির গামলা থেকে জাবনা খাচ্ছে একমনে। দিদিমাকে কোথাও দেখা গেল না।
যে লোকটা দাঁতন করছে সে কে তা জানে না পিপুল। এ তার আর একজন মামা নয় তো! মামাদের বড়ো ভয় খাচ্ছে সে। পিপুল লক্ষ করল, কুয়োতলার ওধারে একটু জংলা জায়গা আছে। ওখানে পেচ্ছাপ করে আসা যায়। কিন্তু কে কী বলবে কে জানে! ভরসা এই, এখনও বেলা হয়নি। বাড়ির সবাই বোধহয় ঘুম থেকে ওঠেওনি। ক্ষীণ একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কালকের সেই বাচ্চাটাই কী?
পিপুল খুব সাহস করে সিঁড়ি দিয়ে খুব আস্তে আস্তে নামতে লাগল। বুক দুরদুর করছে, গলা শুকিয়ে আসছে। এরকম অদ্ভুত ভয়-ভয় এর আগে তার কখনো হয়নি। নীচের দরদালানে সিঁড়িটা যেখানে ঘুরে নেমে গেছে সেখানকার চাতালে দাঁড়িয়ে সাবধানে রেলিং এর ওপর দিয়ে দেখে নিল সে। একজন বউমতো মানুষ একেবারে ওধারে বসে কুটনো কুটছে। বউটি তাকে হয়তো দেখতে পাবে না, কিন্তু উঠোনের দাঁতনওলা লোকটা পাবে।
কিন্তু পিপুলের আর উপায় নেই। সে সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে নেমে দরজা দিয়ে বেরিয়ে উঠোনে নেমে পড়ল। দাঁতনওলা লোকটার দিকে তাকালই না পিপুল। একরকম তার নাকের ডগা দিয়েই একছুটে গিয়ে কচুবনের মধ্যে বসে পড়ল।
ওটা কে রে ঝিকু? একটা হেঁড়ে গলা হেঁকে উঠল।
যারা বাসন মাজছিল তাদের একজন বলল, ওই তো তোমাদের বোনের ছেলে, যাকে নিয়ে কাল অত হাঙ্গামা হল!
কিন্তু এ তো দিব্যি ছুটে গেল দেখছি! শুনলুম যে সাংঘাতিক জ্বর! মা বলছিল।
তা জ্বর হতেই পারে বাপু। যা মার মেরেছ ওকে তোমরা। ওরকম মারের তাড়সে জ্বর হবে না তো কী! ওইটুকু তো ছেলে!
বেশি ফটফট করিস না। কাল আমার ঘরে ঢুকে কী করেছে জানিস?
ঝিকু নামের ঝি-টা একটু সাহসী আর মুখ-আলগা। ঝঙ্কার দিয়ে বলল, ওসব বলে কি লোকের চোখে ধূলো দেওয়া যায়? ওইটুকু ছেলে খামোখা ঘরে ঢুকে তোমার বাচ্চাকে আছড়াবে কেন? বাচ্চা গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল, ও গিয়ে তুলেছে! তোমরা বাপু দিনকে রাত করতে পার।
হেঁড়েগলা বলল, চুপ করবি না কী? আমাদের ব্যাপার আমরা বুঝব!
তোমাদের ব্যাপার আবার কী? ভাগ্নে বলে তাকে মারবে এটাই কী নিয়ম নাকি?
পিপুলের পেচ্ছাপ হয়ে গেছে। সে ভয়ের চোটে কিছুক্ষণ বসে রইল এমনি। কিন্তু বেলাভর তো বসে থাকা যাবে না।
দাঁতনওলা লোকটা এইবার তার উদ্দেশেই একটা হাঁক মারল, এই ছোঁড়া, ওখানে কি করছিস, অ্যাঁ?
পিপুল উঠল। ঝিকুর জন্যই তার একটু সাহস হল। ঝিকুটা বোধহয় দজ্জাল। এরা বোধহয় ওকে একটু ভয় খায়।
এদিকে আয় তো! দাঁতনওলা ডাকল।
পিপুল খুব ভয়ে ভয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটা হ্যাঁক থুঃ করে মুখ থেকে খানিকটা দাঁতনের ছিবড়ে ফেলে বলল, তোর নাকি জ্বর?