দাদু তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে চাপা ধমক দিল কুকুরটাকে, অ্যাই, চোপ!
কুকুরটা লেজ নাড়তে লাগল।
রান্নাঘরে তাকে পিঁড়িতে বসিয়ে একটা থালায় ভাত বেড়ে দিল দিদিমা। বেশ তাড়াহুড়োর ভাব। বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে ভাই।
পিপুলের বিশাল খিদে মরে গেছে অনেকক্ষণ আগে। এখন তার একটা বমি-বমি ভাব হচ্ছে। দু-তিন গ্রাস ভাত মুখে দিয়ে সে কেবল জল খেতে লাগল ঢকঢক করে। জল খেয়েই পেট ভরে গেল। আর কেমন শীত করতে লাগল।
কিছু একটা সন্দেহ করেই দিদিমা তার কপালে হাত দিয়ে বলল, ইস, তোর যে জ্বর এসেছে দেখছি! গা পুড়ে যাচ্ছে।
পিপুলের খুব ঘুম পাচ্ছে। আর শুধু জলতেষ্টা
দিদিমা গিয়ে দাদুকে ডেকে এনে বলল, ছেলেটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, কী করবে?
দাদু চিন্তিতভাবে বলে, অনেক ক্ষত হয়েছে দেখছি। কেটেকুটে বিষিয়ে গেছে। ব্যথার তাড়সে জ্বর।
তোমার হোমিও চিকিৎসায় হবে না?
হবে না কেন? তবে চোর-কুঠুরিতে রাখলে আজ রাতেই মরে যাবে। ওকে আমাদের ঘরে নিয়ে ঢেকেঢুকে শোওয়াও। আমি চারদিকটা দেখে নিয়ে আসছি।
অনেকক্ষণ বাদে এই প্রথম পিপুল তার জ্বরঘোরেও বুঝতে পারছিল, এ পৃথিবীতে এখনও দুটি মানুষ অবশিষ্ট আছে যারা তাকে একটু-আধটু মায়া করে।
পিপুলকে ধরে তুলল দিদিমা। তারপর দাদুকে বলল, শোনো, এই ছেলে নিয়ে অনেক গন্ডগোল হবে। কালী এসে কুরুক্ষেত্র করবে। তুমি একবার গৌর মিত্রের কাছে যাও এখনই। তাকে সব বলো গিয়ে।
দাদু একটু যেন ভয় খেয়ে বলে, গৌর মিত্তির। বলো কী? গৌর রগচটা লোক, খুনোখুনি করে ফেলতে পারে! শত হলেও কালী আমাদের ছেলে!
দিদিমা খুব শান্ত গলায় বলে, ছেলে আমারও কিন্তু আমি তার মা হয়েও বলছি, গৌর মিত্তিরকে একটা জানান দিয়ে রাখো। সে ষন্ডাগুন্ডা হতে পারে, কিন্তু দশজনের উপকারও করে। আমরা বুড়োবুড়ি পেরে উঠব না, কালী এ ছেলেকে মেরে তবে ছাড়বে।
দাদু একটু দোনোমোনো করে বলল, তাই যাচ্ছি। তুমি একে ভালো করে ঢেকে শোওয়াওগে। আমি আসছি।
দিদিমা পিপুলকে দোতলার একখানা ঘরে নিয়ে এল। বেশ বড়ো ঘর। মস্ত খাট পাতা। মশারি ফেলা। সেই খাটের বিছানায় তাকে শুইয়ে একটা কাঁথা চাপা দিয়ে বলল, ঘুমো–ভয় নেই। তোর জন্যই বোধহয় আজও অবধি আমরা বেঁচে ছিলাম। আমাদের প্রাণ যতক্ষণ আছে ততক্ষণ মরবি না। ঘুমো তো ভাই।
পিপুলকে আর বলতে হল না। নরম বিছানা পেয়েই তার শরীর অবসন্ন করে এক গাঢ় ঘুম ঢেকে ফেলল তাকে।
মাথার দিককার মস্ত জানালা দিয়ে যখন ভোরের লালচে রোদ এসে বিছানা ভরে দিল তখন চোখ চাইল পিপুল। বিছানায় সে একা। তার দুধারে দাদু আর দিদিমা যে রাত্রে শুয়েছিল তা বালিশ আর বিছানা দেখেই সে টের পেল। দেখতে পেল তার শরীরে কাটা আর ফাটা জায়গাগুলোয় তুলো আর ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। তা বলে ব্যথা সে কিছু কম টের পাচ্ছিল না। জ্বরের একটা রেশ শরীরে রয়েছে এখনও। আর বড্ড তেষ্টা।
বাড়িটা নিস্তব্ধ। কোনো গোলমাল বা চেঁচামেচি নেই। তবু কান খাড়া করে রইল পিপুল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসল। বিছানা ছেড়ে ধীরপায়ে গিয়ে জানলায় দাঁড়াল। এটা পুব দিক। সামনেই সেই পুকুরটা। ওপাশে কিছু বাড়িঘর। তার ওপাশে সূর্য উঠছে। কী সুন্দর দৃশ্য! পুকুরের স্থির জলে ভোর আকাশের ছায়া।
দিদিমা পিছন থেকে হঠাৎ কথা বলে উঠতেই একটু চমকে গেল পিপুল।
উঠেছিস? দেখি গা-টা দেখি, কত জ্বর।
পিপুল কপালটা এগিয়ে দিল। তারপর চাপা গলায় বলল, কালীমামা ফিরেছে?
দিদিমা একটু হাসল, ফিরেছে। তোর ভয় নেই। রাত বারোটায় ফিরেই চোরকুঠুরির চাবি চাইল। দিইনি। নেশা করে আসে, অত বুদ্ধি কাজ করে না। তবু একটু চেঁচামেচি করেছিল ঠিকই। রাত সাড়ে বারোটায় গৌর মিত্তির এল। সে আসতেই সব ঠাণ্ডা।
গৌর মিত্তির কে দিদিমা?
দিদিমা বলে ডাকলি নাকি ভাই! সোনা আমার! গোপাল আমায়! কখন থেকে কানদুটো পেতে আছি, ডাকটা শুনব বলে।
ফোকলা মুখের হাসিটি এত ভালো লাগল পিপুলের। সে বলল, বললে না?
গৌর মিত্তির তো! তার কথা কী-ই বা বলি তোকে! সে ষন্ডাগুন্ডা লোক, সবাই তাকে ভয় খায়। চন্ডালের মতো রাগ। লোকের ভালোও করে, মন্দও করে। এখানে তার খুব দাপট।
সে এসে কী করল?
তোর দাদু গিয়ে তাকে সব খুলে বলেছিল। সে দেরি করেনি। তখন-তখনই চলে এসেছিল। কালী শুতে গিয়েছিল, তাকে তুলে এনে চোখ রাঙিয়ে শাসিয়ে গেল। আর তোর ভয় নেই। গৌর মিত্তির যখন আশ্রয় দিয়েছে, কালী আর ভয়ে কিছু করবে না!
কালীমামা কি খুব রাগী?
খুব। রাগ বলে নয় রে ভাই, রাগী মানুষ অনেক থাকে। সে হল বংশের কুড়ুল। অশান্তির শেষ নেই রে ছেলে।
আমি এখন কী করব দিদিমা? বাবা তো শুনেছি হাসপাতালে, কে আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে?
বাড়িতে তোর তো ঠাকুর্দা আর কাকা আছে না? তারা তোকে দেখে-শোনে?
পিপুল চুপ করে রইল।
সেখানে তোর আদর নেই, না?
না।
তবে সেখানে গিয়ে কী করবি? এখানে থাকতে পারবি না?
এখানে! বলে আতঙ্কে চোখ বড়ো করে ফেলল সে।
দিদিমা দুঃখের গলায় বলে, থাকতে তো বলছি, কিন্তু এ বাড়িতে আমাদের কী আর জোর আছে? এখন বুড়োবুড়িকে পারলে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আমাদেরই ঠাঁই নেই। তবু শ্বশুরের ভিটে আঁকড়ে আর বুড়োটার মুখ চেয়ে পড়ে আছি। এখানে কী আর শান্তিতে থাকতে পারবি? যদি শতেক অত্যাচার সয়ে থাকতে পারিস তবে হয়। যতদিন আমরা আছি তোকে আগলে রাখব।