কাঁদতে কাঁদতে পিপুল অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বেলা কত হল, দিন গিয়ে রাত এল কিনা সে জানে না, তবে যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখল, তার সামনে লণ্ঠন হাতে একটা বুড়ি দাঁড়িয়ে। সেই বুড়িটাই যে তাকে আর মারতে কালীপদকে নিষেধ করেছিল।
বুড়ি বলল, তুই কি পিপুল?
পিপুল ভয়-খাওয়া গলায় বলে, হ্যাঁ।
আমি তোর দিদিমা, জানিস?
দিদিমা-টিদিমা পিপুলের কাছে কোনো সুখের ব্যাপার নয়। সে বুঝে গেছে মামাবাড়ির পাট তার চুকে গেছে। সে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন, আপনাদের পায়ে পড়ি।
তুই কি বাচ্চাটাকে সত্যিই আছাড় মেরেছিলি?
পিপুল সবেগে মাথা নেড়ে বলল, না, আছাড় মারব কেন? বাচ্চাটা খাট থেকে পড়ে গিয়ে ভীষণ কাঁদছিল, আমি গিয়ে কোলে নিয়েছিলাম।
দিদিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তাই হবে। তোর কপালটাই খারাপ। ছোটো বউ এমন চেঁচামেচি করল যে সকলে ধরে নিল, আছাড় মেরে ছেলেটাকে তুই মেরে ফেলতে চেয়েছিলি। এ বাড়িতে যে কী অশান্তি রে ভাই, কী আর বলব! খুব মেরেছে তোকে, না?
পিপুল এসব আদুরে কথায় আর বিশ্বাস করে না। সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন, নাকে খত দিচ্ছি, আর আসব না কখনো।
ছেড়ে দেবেটা কে? কালীপদকে তো চিনিস না! কুরুক্ষেত্র করবে। এখন ও বাড়িতে নেই। ফিরতে রাত হবে। কোন মূর্তি নিয়ে ফিরবে কে জানে বাবা!
এ-কথা শুনে পিপুল ফের কাঁদতে লাগল। মনে হচ্ছিল, এই পাতালঘর থেকে আর সে কোনো দিন বেরোতে পারবে না। কাঁদতে গিয়ে দেখল তার হিক্কা উঠছে। মাথা ঝিমঝিম করছে।
দিদিমা উবু হয়ে তার কাছে বসে গায়ে হাত দিয়ে বলল, শোন ভাই, এ বাড়িতে আমিও বড় সুখে নেই। দিন-রাত ভাজা-ভাজা হচ্ছি, কেন যে প্রাণটা আজও ধুকপুক করছে তা বুঝি না। সংসার তো নয়, আস্তাকুঁড়!
আমি বাড়ি যাব।
আমাদের ক্ষমতা থাকলে কি এ সংসারে এভাবে পড়ে থাকতুম!
আমি তো বাচ্চাটাকে ফেলিনি। কিছু তো চুরিও করিনি। তবে কেন আমায় আটকে রাখছেন?
তোর দোষ নেই জানি। কিন্তু তোর বাবা বড্ড খারাপ যে, ওর জন্যই তো মেয়েটা মরল। তাই তোদের ওপর সকলের রাগ। বেঁচে যখন ছিল তখনও বাপের বাড়িতে আসতে দিত না।
আমাকে কি আপনারা আরও মারবেন? আর মারলে কিন্তু আমি মরেই যাব। দিদিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সবই ভবিতব্য রে ভাই। মারলেও কী আটকাতে পারব! আমার কথা কে শুনবে বল!
পিপুলের কান্না থামছিল না। ভয়ে বুকটা বড্ড দুরদুর করছিল। আরও মারবে? কিন্তু কেন মারবে সেটাই যে সে বুঝতে পারছে না!
দিদিমা তার গায়ে একটু হাত বুলিয়ে বলল, শোন ভাই, এখন যদি তোকে ওপরে নিয়ে যাই তাহলে সবাই দেখতে পাবে। কথাটা কালীরও কানে যাবে। তুই বরং মটকা মেরে পড়ে থাক, আর একটু রাত হলে আমি চুপিচুপি আসবখন।
আমার যে বড্ড ভয় করছে!
এই লণ্ঠনটা রেখে যাচ্ছি। এখানে ভয়ের কিছু নেই। এ ঘরটা বেশ পরিষ্কার আছে। তোর কি ভূতের ভয়?
না, আমার এমনিই ভয় করছে।
এইটুকু তো তোর বয়স, ভয় তো করবেই। তবু আর একটু কষ্ট কর দাদা। বেশিক্ষণ নয়। এ বাড়ির সবাই রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়ে। শুধু ভয় কালীপদকে। তার একটু রাত হয় শুতে। তাই চুপটি করে পড়ে থাক। আর এই জলের ঘটিটা রাখ, আর দুটো বাতাসা। চুপটি করে এনেছি। ওদিকে একটা জালা আছে, ঘটিটা ওর পিছনে লুকিয়ে রাখিস।
দিদিমা চলে গেল। পিপুল তার প্রচন্ড তেষ্টা মেটাতে জল খেতে গিয়ে বিষম খেল। তারপর সবটুকু জলই প্রায় খেয়ে ফেলল। তারপর বড়ো বড়ো চারখানা বাতাসা চিবোল গোগ্রাসে। জীবনে যেন এত সুস্বাদু খাবার সে আর খায়নি।
খানিক জেগে, খানিক ঘুমিয়ে কতটা সময় পেরোল কে জানে! তবে এক সময়ে তার অপেক্ষা শেষ হল। ওপরে দরজা খোলার মৃদু শব্দ পেল সে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল, শুধু দিদিমা নয়–দাদুও।
দিদিমা বলল, কী মার মেরেছে দেখছ ছেলেটাকে!
দাদু গম্ভীর গলায় বলল, দেখেছি। কী আর করা যাবে বলো, আমাদের তো কিছু করার ছিল না।
এখন কী করবে?
কিছু করতে যে সাহস হয় না।
তা বলে চোখের সামনে দুধের ছেলেটাকে মরতে দেখব নাকি? শত হলেও নিজের নাতি। আমাদের আর ভয়টা কীসের বলো। বেঁচে থেকেও তো মরেই আছি।
দাদু চিন্তিত মুখে পিপুলের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, একেবারে মায়ের মুখের আদল, দেখেছ?
দিদিমা ঝংকার দিয়ে বলল, আমি কী ছাই চোখে ভালো দেখি! তিন বছর হল ছানি পড়ে চোখ আঁধার হয়ে আছে। সব কিছু যেন কুয়াশায় ডোবা, আবছা আবছা। ওরে ভাই, তোর নাম তো পিপুল?
পিপুল চিঁ চিঁ গলায় বলল, হ্যাঁ।
আমাদের সঙ্গে আয়, চাট্টি ভাত খাইয়ে দিই। খিদে পায়নি তোর?
পিপুলের চোখে ভাতের কথায় জল এল। মাথা নেড়ে বলে, আমার কিছু চাই না। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি বাড়ি যাব।
দিদিমা আক্ষেপ করে বলে, ওরে, আমাদের কপাল যদি ভালো হত তাহলে বলতে পারতুম যে, এটাও তোর বাড়ির মতোই। মামাবাড়ি কী ফেলনা নাকি? কত আদর মামাবাড়িতে! তা ভাই, কপালটাই যে আমাদের ঝামা পোড়া। এখন আয় দেরি করিসনি। দেরি করলেই বিপদ। শুধু তোর নয়, আমাদেরও।
এত ভয়ের ওপর ভয়ে পিপুল সিঁটিয়ে যাচ্ছিল। ভাত খাবে কী, তার শরীর এত কাঁপছে যে মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে বুঝি। তবে এই অন্ধকার চোরকুঠুরি থেকে বেরোনোর জন্যই সে ভাত খেতে রাজি হল। দাদু আর দিদিমা চুপিসাড়ে তাকে ওপরে নিয়ে এল। বারান্দার এক প্রান্তে রান্নাঘর। বাড়ি নিঝুম। কত রাত তা জানে না পিপুল। তবে রাত বেশ গভীর বলেই মনে হল তার। উঠোনে একটা কুকুর তাকে দেখে ভেউ-ভেউ করে চেঁচিয়ে উঠল।