পিপুলকে কেউ ডাক-খোঁজ করল না। আর বাড়িসুষ্ঠু লোক বেরিয়ে গেল পুকুরধারে, কী কান্ড হচ্ছে তা দেখতে। পিপুলেরই শুধু দেখতে ইচ্ছে হল না সে উঠোনের কুয়োতলায় গিয়ে কপিকলে বাঁধা বালতি ফেলে জল তুলল। তারপর হাতের কোষে জল ঢেলে গলা অবধি জল খেল।
মনটা ভালো ছিল না তার। বাপের সঙ্গে যদিও তার বিশেষ আদর-আশকারার সম্পর্ক নেই, তবু ওই লোকটা ছাড়া তার কে-ই বা আছে? দাদু কাকা সবাই তাকে মারে। মারে বাবাও। তবে কিছু কম। আর সে এটা জানে যে, দুনিয়ার কোনো রহস্যময় কার্যকারণে এই বাপ লোকটার সঙ্গেই তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
বারান্দায় উঠতে তার সাহস হল না। সে কুয়োতলার পাশে একটা আতা গাছের ছায়ায় বসে রইল উবু হয়ে। বাইরে কী হচ্ছে তা দেখতে গেল না। শুনতে পেল, কোনো ঘরে একটা বাচ্চা খুব চেঁচিয়ে কাঁদছে। খুব কাঁদছে। বোধহয় চৌকি বা খাট থেকে পড়ে-উড়ে গেছে।
একটু অপেক্ষা করে পিপুল ওই বিকট কান্নাটা আর সহ্য করতে পারল না। উঠে পায়ে পায়ে সে এগোল। বারান্দায় উঠে যে-ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসছিল সেই ঘরে উঁকি মেরে দেখল, চার-পাঁচ মাস বয়সের একটা বাচ্চা সত্যিই খাটের নীচে মেঝেয় পড়ে আছে। ইট দিয়ে বেশি উঁচু-করা খাট। বাচ্চাটা পড়ে কপাল ফাটিয়েছে, মুখ নীল হয়ে গেছে ব্যথায়।
পিপুল গিয়ে বাচ্চাটিকে তুলে বিছানায় শোয়াতে যাচ্ছিল, ঠিক এ সময়ে হুড়মুড় করে একটা বউ এসে ঢুকল। তার চোখ কপালে, মুখ হাঁ-করা চুল উড়ছে। ঢুকেই বিকট গলায় চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই, অ্যাই, কী করছিলি এ ঘরে? অ্যাঁ, কী করছিলি? মেরে ফেলেছিস আমার ছেলেটাকে!
পিপুল বলল, না তো। এ পড়ে গিয়েছিল।
খপ করে বাচ্চাটাকে তার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে বউটা পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগল, ওগো, দেখো কী সাংঘাতিক কান্ড! ঘরে ঢুকে বাচ্চাটাকে আছাড় মেরেছে…
আবার একটা চেঁচামেচি উঠল, লোকজন দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল।
তারপর যে কী কান্ড হল তা ভালো করে আজ আর মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, সবাই মিলে তাকে এমন মারতে লাগল চারধার থেকে যে সে চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে পড়ে গেল।
জ্ঞান ফিরল কুয়োর ধারে। কুয়োতলায় তাকে শুইয়ে জল ঢালা হচ্ছিল মাথায় আর গায়ে। সারা গা ভিজে সপসপে। জ্ঞান হতেই টের পেল তার মাথায় আর শরীরে ব্যথা আর জ্বলুনি। মাথার চুল বোধহয় কয়েক খাবলা উঠে গেছে। কান কেটে, কপাল ফেটে রক্ত পড়েছে। হাতে-পায়ে ঝনঝন করছে ব্যথা।
চোখ চেয়েই সে আতঙ্কের গলায় বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি বাড়ি যাব।
সামনে সেই চোয়াড়ে লোকটা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো। তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখ। লোকটার পিছনে পাড়াসুদ্ধ লোক জড়ো হয়েছে।
কে একজন বলল, এ কি আপনার ভাগ্নে?
চোয়াড়ে লোকটা অর্থাৎ কালীপদ তেজের গলায় জবাব দিল, কীসের ভাগ্নে মশাই? ভাগ্নে ফাগ্নে এখন ভুলে যান। বাপ যেমন শয়তান, ছেলে তার চেয়ে কম যায় না। হরিপদর ছেলেটাকে আছাড় মেরে খুন করতে গিয়েছিল–চুরিটুরিরও মতলব ছিল বোধহয়।
সেই লোকটা বলল, সে যাই বলুন, কাজটা আপনারা ভালো করছেন না। বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এর বাপকে তো হাসপাতালে পাঠালেন। যা মার মেরেছেন তাতে ফিরলে হয়। তার ওপর এই একফোঁটা ছেলেটাকে হাটুরে মার দেওয়া হল, আপনারা তো পাষন্ড মশাই।
কালীপদ এ কথায় লাফিয়ে উঠে লোকটার দিকে তেড়ে গেল, ওঃ, খুব যে দরদ দেখছি। যখন এর বাপ আমার বোনটাকে গলা টিপে মেরে দড়িতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল তখন কোথায় ছিলেন?
কালীপদ যে গুন্ডা লোক তা বোঝা গেল সেই প্রতিবাদকারী চুপ করে যাওয়ায়।
কালীপদ বলল, দরদি ঢের দেখা আছে। বেশি ফোপরদালালি করতে এলে মজা বুঝিয়ে দেব।
পিপুল আতঙ্কিত চোখে চারদিকে চেয়ে দেখছে। এরা তাকে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। উঠে একটা দৌড় লাগাবে? কিন্তু শরীর এমন নেতিয়ে পড়েছে যে, উঠে দাঁড়ানোর সাধ্যই নেই!
কালীপদ তার দিকে কটমট করে এমন চেয়েছিল যে পিপুলের রক্ত জল হওয়ার উপক্রম। মারের চোটে ইতিমধ্যেই সে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলেছে। আর তার ভীষণ জলতেষ্টা পাচ্ছে।
কালীপদ কড়া গলায় বলল, এবার বলবি তোর মতলবখানা কী ছিল?
পিপুল কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আর কখনো আসব না।
কিন্তু এসেছিলি কেন?
আমি আসতে চাইনি। বাবা জোর করে এনেছিল।
কালীপদর চোয়ালটা আবার শক্ত হল। বোধহয় আরও একটা চড় মারার জন্যই হাতটা তুলেছিল সে। এমন সময় বারান্দা থেকে একজন বুড়ি চেঁচিয়ে বলল, ওরে ও কালী, এরপর মানুষ-খুনের দায়ে পড়বি যে! অনেক হয়েছে। এটা গেরস্তবাড়ি, রাজ্যের লোক ঢুকে পড়েছে তামাশা দেখতে। ওসব হুড়যুদ্ধ এবার বন্ধ কর বাবা। ওই একফোঁটা ছেলেটাকে আর কত মারবি।
কালী চড়টা মারল না। তবে আরও কিছুক্ষণ তড়পাল। তারপর চাকর গোছের একটা লোককে ডেকে বলল, অ্যাই গোপলা, এটাকে নিয়ে চোরকুঠুরিতে পুরে রাখ। খবর্দার, কিছু খেতেটেতে দিবি না। জল অবধি নয়।
তার মামাবাড়ি পুরোনো আমলের। হয়তো একসময়ে অবস্থা খুবই ভালো ছিল। মাটির নীচে মেটে জলের জালা রাখার মস্ত ঘর আছে। গোপাল তাকে ধরে নিয়ে সেই অন্ধকার পাতাল ঘরে ঠেলে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
ভারি স্যাঁতস্যাঁতে ঘর। ঘুটঘুট্টি অন্ধকারও বটে। পিপুল শরীরে মারের যন্ত্রণা নিয়ে সেখানে মেঝেয় পড়ে কাঁদতে লাগল। পেটের খিদে, গলার তেষ্টা তো ছিলই। আর ছিল অপমান আর লাঞ্ছনা। নিজের বাড়িতেও তার আদর নেই বটে, কিন্তু সেখানে এই হেনস্থা তার কখনো হয়নি।