পিপুল খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। খিদেয় তেষ্টায় বড়ো নেতিয়ে পড়েছে সে। ও বাড়িতে গেলে খেতে দেবে কিনা সেইটেই ভাবছিল সে। আবার ভাবছিল, যদি তাড়িয়ে দেয়!
পুকুরে একজন বউ-মানুষ চান করছিল। ভরদুপুরে আর কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। বউ মানুষটি স্নান সেরে বাড়ির পাকা ঘাটলায় উঠে গামছা নিংড়োতে নিংড়োতে তার দিকে চেয়ে বলে, এই ছোঁড়া, তখন থেকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস ড্যাবড্যাব করে? চুরিটুরির মতলব আছে নাকি? যাঃ এখান থেকে।
পিপুল ভয় খেয়ে গেল। তারপর করুণ গলায় বলল, আমি গিরীশ রায়ের বাড়ি যাব।
কেন রে, সেখানে তোর কি?
পিপুল বলল, সেটা আমার মামাবাড়ি।
মামাবাড়ি! বলে বউটি অবাক, এটা তোর মামাবাড়ি হল কবে থেকে রে ছোঁড়া? চালাকি করছিস?
আমার দাদুর নাম গিরীশ রায়।
বউটা এবার ধমকাল না। খুব ভালো করে তার দিকে চেয়ে দেখল। তারপর বলল, শ্রীরামপুর থেকে আসছিস নাকি?
হ্যাঁ।
তোর বাবার নাম হরিশচন্দ্র?
পিপুল অবাক হয়ে বলে, হ্যাঁ।
কী চাস এখানে? কে তোকে পাঠাল?
বাবার শেখানো কথা সব ভুলে গেছে পিপুল। কিন্তু বেফাঁস কথাও যে বলা চলবে না এ বুদ্ধি তার ছিল। সে বলল, আমার বড়ো জলতেষ্টা পেয়েছে। একটু জল দেবেন?
তেষ্টার কথায় সবাই নরম হয়। বউটাও হল। বলল, আয় আমার পিছু পিছু।
বাড়ির ভিতরে মস্ত ঝকঝকে উঠোন। তাতে ধান শুকোচ্ছে। বেশ কয়েকটা মাড়াই আর খড়ের গাদা। বউটা উঠোনে পা দিয়েই হঠাৎ পাড়া মাত করে চেঁচিয়ে উঠল, দেখেছ তোমরা, কে এসে উদয় হয়েছে। ওই যে খুনে হরিশচন্দ্রের ব্যাটা। নিশ্চয়ই ওই মুখপোড়াই নিয়ে এসেছে।
চেঁচামেচিতে লোকজন বেরিয়ে এল। একজন বুড়ো মানুষ, জনাতিনেক পুরুষ। সকলের চোখ তার দিকে।
পুরুষদের মধ্যে চোয়াড়ে চেহারার একজন বারান্দা থেকে নেমে তার সামনে এসে দাঁড়াল। কড়া গুল্লু গুল্লু চোখে তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, কার ব্যাটা তুই?
আমার বাবার নাম শ্রীহরিশচন্দ্র ঘোষ।
ও বাবা! বাপের নামের আগে আবার শ্রী লাগায় দেখছি। তোর মায়ের নাম কি?
আশালতা ঘোষ।
বারান্দা থেকে সেই বুড়ো লোকটি বলল, অত জিজ্ঞাসাবাদের দরকার নেই। মুখে ওর মায়ের মুখের আদল আছে।
পিপুলের ভারি ভয় আর অপমান লাগছিল। বাবা তাকে এ কোন শত্ৰুপুরীতে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল।
চোয়াড়ে লোকটা বলল, কে তোকে এ বাড়িতে পাঠিয়েছে?
পিপুল কাঁদো-কাঁদো হয়ে মিথ্যে কথাটা বলে ফেলল, কেউ পাঠায়নি।
তুই নিজেই এসেছিস? একা?
পিপুল মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ।
তোর বয়সি ছেলে শ্রীরামপুর থেকে এখানে একা আসতে পারে?
পিপুল চুপ করে থাকল।
কী চাস তুই?
পিপুল মুখস্থ-করা কথাগুলো বলে গেল, আমি মা-মরা ছেলে। বাড়িতে খুব অনাদর। আমার একটু আশ্রয় হলে ভালো হয়।
কাল রাতে তার বাবা তাকে এ কথাগুলোই শিখিয়ে দিয়েছিল। মুখস্থও সে ভালোই বলেছে। কিন্তু হঠাৎ চটাস করে একটা চড় যে কেন এ সময়ে তার গালে এসে পড়ল কে জানে!
বুড়ো লোকটি বলল, আহা, মারিস কেন?
চোয়াড়ে লোকটা বলে, মারব না? কেমন যাত্রার পার্টের মতো শেখানো কথা বলছে দেখো! মা-মরা ছেলে, অনাদর, আশ্রয়–এসব মুখ থেকে কখনো বেরোয়? এই ছোঁড়া, কে তোকে এখানে এনেছে সত্যি করে বল!
মারধরে কিছু হয় না পিপুলের। নিজের বাড়িতে নিত্যই মার খায় সে। রাস্তায়-ঘাটেও ছেলেদের সঙ্গে তার নিয়মিত মারপিট হয়। স্কুলে মাস্টারমশাইরা ঠেঙিয়ে তার ছাল তুলে দেন মাঝে মাঝে। চড়টা খেয়েও তাই সে দমেনি। কিন্তু বাবার কাজটা যে হবে না সে বুঝতে পারছিল। সে চোয়াড়ে লোকটার দিকে চেয়ে সত্যি কথাই বলল, বাবা নিয়ে এসেছে আমাকে।
চোয়াড়ে লোকটা লাফিয়ে উঠে বলল, কোথায় সেই শয়তানটা? আজ ওটাকে পুকুরের কাদায় পুঁতে রাখব। লাশটাও কেউ খুঁজে পাবে না। বল ছোঁড়া, কোথায় খুনে বদমাশটা?
পিপুল মাথা বাঁচাতে বলে ফেলল, একটা চায়ের দোকানে বসে আছে। মোড় পেরিয়ে বাঁ দিকে।
চোয়াড়ে লোকটা সঙ্গেসঙ্গে দুই লম্ফে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর যা হয়েছিল তা দেখেনি পিপুল। তবে শুনেছে। তার মেজো মামা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে হাঁকে-ডাকে লোক জোগাড় করে চায়ের দোকান থেকে তার বাপকে টেনে বের করে হাটুরে মার মারে। হাসপাতালে দিন পনেরো পড়ে থাকতে হয়েছিল তার বাপকে। পুলিশ-কেস হয়েছিল। বিরাট গন্ডগোল।
কিন্তু ইতিমধ্যে পিপুলের যা হয়েছিল সেইটেই আসল কথা। মামা বেরিয়ে যাওয়ার পরই দাদামশাই অর্থাৎ সেই বুড়ো মানুষটি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে লাগলেন, ওরে কি জানি কোন খুনোখুনি হয়ে যায়! ওরে তোরা দেখ, কালীপদর মাথা তো গরম, কী কান্ড করে ফেলে!
দাদামশাইয়ের চেঁচামেচিতে কয়েকজন মহিলা নানা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁদের মধ্যে একজন পাকাচুলো বুড়ি। পরে জেনেছে সে-ই দিদিমা। তবে দাদু দিদিমা মাসি মামি সব কেমন হয় তা তো জানা ছিল না পিপুলের। সে হাঁ করে এঁদের দেখতে লাগল।
দিদিমা তার দিকে চেয়ে বলল, এ ছেলেটা কে?
দাদু বলল, তোমার নাতি গো, চিনতে পারছ না? আশার মুখ একেবারে বসানো!
দিদিমা ভারি অবাক, আশার ছেলে? এর নামই তো পিপুল।
তা হবে। নাম-টাম জিজ্ঞস করা হয়নি। ওদিকে কালীপদ যে কোন সর্বনাশ করতে বেরিয়ে গেল কে জানে! এর বাপটাকে বোধ হয় ঠেঙিয়েই মেরে ফেলবে। হাতে না হাতকড়া পড়ে।