কে বলল নেই?
বাবা যদি রণিতাকে বিয়ে করে, তাহলে কি আর বাবা আমাদের বাবা থাকবে?
বাবা সব সময়েই বাবা। কিন্তু অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? কাকিমা ঠিক ভালো হয়ে উঠবেন। ওঁর অসুখটা সিরিয়াস নয়। মেন্টাল শক থেকে ওরকম হয়।
অদিতির চোখ ছলছল করে, মা ছাড়া আমাদের যে কী হবে?
রণেশের বড়ো সন্তানটি ছেলে, তার নাম অতিথি। ছোটোটি মেয়ে–তার নাম মোনালিজা। তারা চমৎকার দুটি ছেলে-মেয়ে, কিন্তু তাদেরও বাস স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে। এই বাস্তব পৃথিবীর কিছুই প্রায় তারা জানে না। সারাদিন তারা পিপুলের মুখের দিকে চেয়ে থাকে, পিপুল যা করার করবে, তাদের যেন কিছু করার নেই। তবে তারা পিপুল যা বলে তাই নীরবে এবং বিনা প্রতিবাদে করে। এমনকী পিপুলের সঙ্গে রাতেও জেগে থাকার চেষ্টা করতে করতে ধারাশ্রীর বিছানার চারপাশে নানা ভঙ্গিতে শুয়ে বা বসে ঘুমিয়ে পড়ে।
জেগে থাকে পিপুল। চুপচাপ বসে বই পড়ে, কিংবা ভাবে। তার ঢুলুনিও আসে না। কঠিন বাস্তবের সঙ্গে পাঞ্জা কষে সে বড়ো হচ্ছে। সে তো এদের মতো পরীর রাজ্যের মানুষ নয়।
দ্বিতীয়ত রাতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠে অদিতি বলল, আচ্ছা পিপুলদা, তোমাকে কি আমি এক কাপ কফি করে দেব?
হঠাৎ একথা কেন?
আমার বাবা যখন রাত জাগে তখন কফি খেতে দেখেছি।
পিপুল হাসল, আমি চা বা কফি বিশেষ খাই না। আমার কোনো নেশা নেই।
আমার বাবা হুইস্কি খায়, তুমি খাও?
অদিতি আপনি থেকে প্রথম দিনেই তুমিতে নেমে গেছে। তিন ভাই-বোনই তাকে বোধহয় একটু আপনজন বলে ধরে নিয়েছে, তাই দাদা আর তুমি বলছে। পিপুলের ভালোই লাগছে এদের।
সে বলল, আমি মদ খাই না। কোনোদিন খাবও না।
কেন খাবে না? খাওয়াটা খারাপ, তাই না?
খুব খারাপ। মদ খেত বলেই তো আমার বাবার আজ কত দুর্দশা। তাকে দেখেই আমার চোখ খুলে গেছে।
মার কাছে শুনেছি তোমার খুব দুঃখ। সত্যি?
কাকিমা তোমাকে বলেছে বুঝি?
তোমাকে যখন নিয়ে এল তখন আমাদের আড়ালে বলেছে। তুমি কি খুব গরিব?
খুব। দিদিমার কাছে আশ্রয় না পেলে কী হত কে জানে।
আমার বাবাও খুব গরিব ছিল, জান?
জানি। রণেশকাকা আমাকে সব বলেছে।
গরিব কি ভালো হয়?
তার কী কিছু ঠিক আছে? ভালোও হয়, মন্দও হয়।
তুমি কিন্তু খুব ভালো। ভীষণ।
পিপুল হাসল। এই সরলা বালিকার মধ্যে এখনও পাপ ঢোকেনি। এদের ভগবান কী চিরকাল এরকম নিষ্পাপ রাখবেন?
তিন দিন বাদে চতুর্থ দিন সকালে ধারাশ্রী তার বিপদ কাটিয়ে উঠে বসল। শরীর দুর্বল, কিন্তু রক্তচাপ কমছে। কথাবার্তার অসংলগ্নতাও আর নেই। ছেলে-মেয়েদের কাছে ডেকে অনেকক্ষণ তৃষিত চোখে চেয়ে দেখল তাদের। তারপর বলল, এ ক-দিন কি করলি তোরা? কে তোদের দেখল?
কেন, পিপুলদা! সবাই সমস্বরে বলে উঠল।
ধারাশ্রী পিপুলের দিকে চেয়ে বলল, তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম, তাই না?
আপনার কষ্টের তুলনায় আমারটা কিছুই না। আপনি ওসব ভাববেন না।
তোমার কলেজের ক্ষতি হল তো?
পুষিয়ে নেবো। আজকাল কলেজে তেমন পড়াশুনো হয় না।
দিদিমা ভাবছে না?
দিদিমা একটু ভাববে। তাই আজ একবার বাড়ি যাব।
এসো গিয়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে চলে এসো। তোমার রণেশকাকা আমাদের ত্যাগ করেছে, তাই বলে তুমি কোরো না কিন্তু।
এতকাল দিদিমা ছাড়া আর কারো মায়া ছিল না তার। এই প্রথম রণেশের পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে তার কষ্ট হচ্ছিল। তিন দিনে মায়ায় জড়িয়ে পড়ল নাকি সে!
ফিরে আসার পর রণেশের স্টুডিয়োতে বসে ছবি আঁকতে আঁকতে প্রায়ই তিন দিনের নানা স্মৃতি এসে হাজির হয়। অদিতির মুখখানা খুব মনে পড়ে তার। আঁকতে চেষ্টা করে, পারে না অন্যরকম হয়ে যায়।
তিন মাস আর কোনো খোঁজখবর নেয়নি পিপুল। মন থেকে ধীরে ধীরে মুছেই যাচ্ছিল ওরা। পিপুলের নিজেরও অনেক কাজ। পড়াশুনো, ব্যায়াম, ছবি আঁকা, পরোপকার করে বেড়ানো। মাসতিনেক বাদে হঠাৎ একদিন রণেশ এসে হাজির। চেহারাটা অনেক ভালো হয়েছে, গায়ের রং ফর্সা হয়েছে, মুখটা একটু বেশি গম্ভীর।
পিপুলের সঙ্গে দেখা হতে বলল, কেমন আছিস?
ভালো। আপনি কেমন?
আমিও ভালো। তুই তো দেখছি অ্যাডাল্ট হয়ে গেছিস!
পিপুল অস্বস্তির সঙ্গে হাসল।
রণেশ তার ঘরে আরামচেয়ারে বসে মাথার পাতলা চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলল, আমার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছিস, না?
হ্যাঁ। কাকিমা খুব আপসেট।
হওয়ারই কথা। কুড়ি বছরের ম্যারেড লাইফ। একটা অভ্যাসও তো হয়ে যায়।
আপনি কাকিমার কাছেই আছেন তো?
দেখা করেছি, কিন্তু থাকব না। এত পাগলামি করছে যে সহ্য করা মুশকিল।
আপনি কি রণিতাদিকে বিয়ে করবেন?
বিয়ের প্রশ্ন ওঠে না। ধারা তো ডিভোর্স দেয়নি। তবে দিলে ভালো করত। এখন ও পাগলামি করছে বটে, কিন্তু মরা-সম্পর্ককে কী বাঁচানো যায়?
পিপুল মরা বা জ্যান্ত কোনো সম্পর্কের কথাই জানে না। তবে নিজের বাবার কথা মনে পড়লে সে একটা মৃত সম্পর্কের জের টের পায়। জন্মদাতা বাপ, তবু কতই না পর!
রণেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ধীরস্বরে বলল, কখনো আমাকে মানুষ বলেই ধারা গ্রাহ্য করল না। আমার ভালো-মন্দ দেখল না। এখন যেই সম্পর্ক ভাঙতে চলেছে তখন ক্ষেপে উঠেছে। এসব পাগলামিকে ভালোবাসা বা সেন্টিমেন্ট বলে ভাবিস না যেন–এ হল আহত অহং। ও রণিতার কাছে হার মানতে চাইছে না।
আপনি তাহলে কী করবেন?