এখানে কেউ রণেশকাকার চরিত্র নিয়ে কখনো কিছু বলেনি?
এখানকার লোক ওকে জানে না। অনেকদিন ধরেই ও আর আমাকে পছন্দ করছে না, টের পাচ্ছি। এখানে পড়ে থাকে, কলকাতায় যেতে চায় না। গেলেও কেমন আলগোছ হয়ে থাকে। আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না, তুমি কি জান?
পিপুল না বলতে পারল না। কথার ফাঁকে ফাঁকে রণেশ তাকে ইঙ্গিত দিয়েছে যে, স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। ধারাশ্রী বড্ড অহংকারী আর আত্মসর্বস্ব। রণেশের টাকার দিকেই তার নজর। পিপুল অবশ্য সেসব বলল না। মুখে সমবেদনা মেখে বসে রইল সামনে।
ধারাশ্রী অনেক কথা বলল। বিয়ের পর প্রথম চূড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে শুধু পরস্পরের ওপর নির্ভর করে কেমন করে তারা বেঁচে ছিল। কত ভালোবাসা আর বিশ্বাস ছিল দু-জনের প্রতি দু-জনের। বহুবার কাঁদল ধারাশ্রী।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল, পিপুল জোর করে ধারাশ্রীকে নিয়ে গেল দিদিমার কাছে। ভাত খাওয়াল। তারপর বলল, বিকেলের গাড়িতে আমি গিয়ে কলকাতায় পৌঁছে দেব আপনাকে। আপনি একটু ঘুমোন।
খুবই ক্লান্ত ছিল ধারাশ্রী। বোধহয় রাতের পর রাত ঘুমোয় না। বলতেই বিছানায় শুল এবং ঘুমিয়ে পড়ল।
সন্ধ্যের সময় উঠে বলল, পিপুল, তুমি আজ আমার সঙ্গে কলকাতায় যাবে, কিন্তু তোমাকে ফিরতে দেব না–কাল ফিরো।
টালিগঞ্জের বাড়িতে একবার আগেও এসেছিল পিপুল। সুন্দর ছোটো একখানা দোতলা বাড়ি। একতলায় সবটা জুড়ে স্টুডিয়ো। ছবি বিশেষ নেই। কারণ রণেশের ছবি আজকাল আঁকা মাত্র বিক্রি হয়ে যায়।
রণেশের দুই মেয়ে, এক ছেলে। ছেলে বড়ো, মেয়েরা কিশোরী। ফুটফুটে সুন্দর চেহারা তাদের। মা-বাবার ডিভোর্সের আশঙ্কায় প্রত্যেকেই কেমন যেন ভীতু, লাজুক আর সংকুচিত। কথা বলছে না কেউ।
এরকম মুহ্যমান বাড়িতে থাকা খুব কষ্টকর। পিপুলের অস্বস্তি হচ্ছিল।
এত দুঃখের মধ্যেও ধারাশ্রী তার কোনো অযত্ন করল না। নিজের হাতে রান্না করে তাকে খাওয়ালো রাতে। বলল, তোমাকে আমার অনেক কথা বলার আছে। আমার জীবনটা যে ছারখার হয়ে গেল সে-কথা তো সবাইকে বলা যায় না।
পিপুল বুঝতে পারছিল না, তাকেই বা ধারাশ্রী এত দুঃখের কথা বলতে চায় কেন? সে তো ধারাশ্রীর কাছে প্রায় অচেনা একটি ছেলে। তাকে আজ ধরেই বা রয়েছে কেন ধারাশ্রী?
নীচের স্টুডিয়োতে একটা ক্যাম্প-খাটে বিছানা পাতাই থাকে। রণেশ এখানে বিশ্রাম নেয়। সেই বিছানায় শুয়ে সবে চোখ বুজেছে পিপুল, এমন সময় ধারাশ্রী এল। একটা চেয়ার টেনে তার মুখোমুখি বসে বলল, আমি এখন অনেক কথা বলব তোমাকে। শুধু শুনে যেও, জবাব দেওয়ার দরকার নেই। কথাগুলো বলতে না পারলে আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাব।
পিপুল উঠে বসে বলল, আপনি বলুন।
সারারাত কথা বলল ধারাশ্রী। তাদের প্রেমের কথা, বিয়ের কথা, ছেলে-মেয়ে জন্মানোর কথা, দারিদ্র্যের কথা, তারপর প্রেমছুট হওয়ার কথা, তার সঙ্গে ধারাশ্রীর নিজের জীবনের নানা ঘটনার কথা বলতে বলতে কথার খেই হারিয়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। অসংলগ্ন হয়ে পড়ছিল। পিপুল খুব মন দিয়ে অনুধাবন করছিল ধারাশ্রীকে। কিন্তু বুঝতে পারছিল ধারাশ্রী স্বাভাবিক নেই। খানিকটা পাগলামি দেখা দিয়েছে বোধহয়।
সকালে ধারাশ্রী এত ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল ঘাড় কাত করে। সকালে রণেশের ফুটফুটে বড়ো মেয়েটি নেমে এল দোতলা থেকে। মাকে চেয়ারে বসে ঘুমোতে দেখে একটু অবাক হয়ে পিপুলের দিকে চেয়ে বলল, ইজ শি সিক?
পিপুল কী বলবে ভেবে পেল না। মাথা নেড়ে বলে, বুঝতে পারছি না। সারারাত কথা বলেছেন।
আজকাল মা বড্ড বেশি কথা বলছে। একা-একাও বলে। ওকে কি ডাক্তার দেখানো উচিত?
আমার তো সেটাই ভালো মনে হয়।
আপনি কি আজকের দিনটা থাকতে পারবেন?
কেন বল তো?
মেয়েটা লাজুক মুখে বলল, আসলে আমাদের মন ভালো নেই কারো, মা যদি সিক হয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের কিছু হেল্প দরকার।
পিপুল বলে, যদি কিছু করার থাকে করব। ওটা নিয়ে ভেবো না।
ডাক্তার এল, দেখল। সঙ্গেসঙ্গে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল ধারাশ্রীকে। তারপর বলল, এ বাড়িতে বড়ো কেউ নেই?
পিপুল বলল, আমি আছি।
ওঃ! বলে ডাক্তার তার বড়ত্বে একটু সন্দেহ প্রকাশ করে বলল, এক্সট্রিম মেন্টাল প্রেসার। হাইপারটেনশনটাও বিপজ্জনক। প্রেসক্রিপশন দিয়ে যাচ্ছি, ওষুধগুলো ঠিকমতো যেন দেওয়া হয়।
একদিনের জায়গায় পিপুলকে থাকতে হল তিন দিন। তিন দিন কাটল দারুণ উদ্বেগে, অনিশ্চয়তায়। ঘুম ভাঙলেই ধারাশ্রী নানা অসংলগ্ন কথা বলে, হাসে, কাঁদে। বিছানা ছেড়ে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল একবার। বিছানার কাছাকাছি পিপুল চেয়ারে বসে থাকে দিন-রাত। প্রয়োজন হলে ডাক্তার ডাকে ফোনে, ওষুধ এনে দেয়। তিন দিন ধরে সে বুঝতে পারল, রণেশের তিন ছেলে-মেয়েই অপদার্থ বাস্তববুদ্ধিবর্জিত। অতি আদরে এরা কেউ কাজের মানুষ হয়নি। এমন কী রান্না-খাওয়া অবধি বন্ধ হতে বসেছিল। পিপুল বেগতিক দেখে বাজার করে আনল, নিজেই রান্না করল এবং পরিবেশন করে খাওয়াল সবাইকে। মায়ের অসুখে ভেঙেপড়া তিনটে ছেলে-মেয়েকে প্রবোধ দেওয়ার কাজটাও তাকে করতে হল সঙ্গেসঙ্গে।
বড়ো মেয়েটির নাম অদিতি। ফর্সা। দারুণ সুন্দর বছর সতেরোর মেয়েটিকে মেমসাহেব বলে ভুল হয়। অন্য দুটিও প্রায় সমান সুন্দর, কিন্তু অদিতি দারুণ। কিন্তু সুন্দর বলেই কী একটু বেশি সরল? মাঝে মাঝেই সে পিপুলকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা পিপুলদা, মা যদি মরে যায়, তাহলে আমাদের কী হবে? বাবা তো আর আমাদের বাবা নেই!