রণেশ যখন প্যারিসে তখন পিপুল রণেশের স্টুডিয়ো দেখেশুনে রাখত। রণেশের রং তুলি নিয়ে ক্যানভাসে ইচ্ছেমতো ছবিও আঁকত। রণেশ তাকে সে অধিকার দিয়েই গেছে।
এক রবিবার রণেশের স্টুডিয়োতে বসে সকালের আলোয় ছবি আঁকছিল পিপুল, এমন সময় দরজার কড়া নড়ল। দরজা খুলে পিপুল দেখে, রণেশের পুরুষালি কুচ্ছিত বউ ধারাশ্রী দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রমহিলা একটু কঞ্জুস এবং খিটখিটে। কণ্ঠস্বরে মিষ্টতা নেই। সম্ভবত বউয়ের জন্যই রণেশ আলাদা থাকত। পিপুলও ধারাশ্রীকে তেমন পছন্দ করে উঠতে পারেনি কখনো।
কিন্তু এই সকালে ধারাশ্রীর মুখচোখের ভাব অন্যরকম। ভীষণ অসহায়, বিবর্ণ, কাঁদো কাঁদো।
পিপুল একটু অবাক হয়েই বলল, আসুন কাকিমা।
ধারাশ্রী ভিতরে এল। চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে গা এলিয়ে হাঁফ ছাড়ল কিছুক্ষণ। ধারাশ্রী কদাচিৎ এখানে আসে। আসবার দরকারই হয় না। কলকাতায় তাদের নিজস্ব চমৎকার একখানা বাড়ি আছে। ছেলে-মেয়েরা ভালো ইস্কুলে পড়ে। গাড়ি কেনা হয়েছে সম্প্রতি।
ধারাশ্রী হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তুমি রণিতা বলে কোনো মেয়েকে চেনো?
পিপুল অবাক হয়ে বলে, রণিতা চৌধুরি? হ্যাঁ, পরিচয় হয়েছিল।
এখানে আসত?
দু-বার এসেছিল।
দু-বার? এসে কি রাত কাটিয়েছে?
পিপুল তটস্থ হয়ে বলে, না। রণেশকাকার সঙ্গে ছবি নিয়ে কীসব কথাবার্তা হচ্ছিল। দু বারই বিকেলের ট্রেনে ফিরে গেছে।
ঠিক জান? নাকি লুকোচ্ছ?
না, আমি জানি। রণিতাদিকে আমি নিজেই ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছি।
ধারাশ্রী হঠাৎ বলল, ওদের সম্পর্কটা কীরকম তা কি তুমি জান?
না তো! কী জানব?
ন্যাকা সেজো না। এখন বড়ো হয়েছ, সবই তোমার বুঝবার কথা।
আমি কিছু জানি না।
রণেশ যে রণিতাকে বিয়ে করবে ঠিক করেছে তা জান?
হতভম্ব পিপুল বলে, না তো!
তুমি খুব সেয়ানা ছেলে, তাই না? সব জেনেও বোকাটি সেজে আছ। রণিতা আর রণেশের বৃন্দাবন ছিল এইখানে। তুমি রণেশের শাগরেদ, তোমার না জানার কথা নয়।
পিপুল বিপদে পড়ে বলল, আমি কিছুই জানি না।
জানলেও বলবে না। তুমিই ওই রায়বাড়ির ভাগ্নে! তোমার বাবা তো শুনেছি মাতাল আর লম্পট। তুমি তো চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা হবেই।
পিপুল এখন কলেজে পড়ে, দাড়ি কামায় এবং একটা ছোটোখাটো দলের সর্দারি করে। এ তল্লাটে তার একটা নামডাক আছে। ছেলেবেলায় যা হয়েছে হয়ে গেছে। কিন্তু এখন কেউ তাকে এত সরাসরি অপমান করতে সাহস পায় না। তার আত্মমর্যাদাজ্ঞান খুব টনটনে। রণেশের বউ বলে সে এতক্ষণ কিছু বলতে দ্বিধা করছিল, কিন্তু এবার আর সামলাতে পারল না। বলল, আপনি এত অভদ্র কেন?
এ কথায় ধারাশ্রীর ফেটে পড়ার কথা রাগে। কিন্তু ফল হল উলটো। হঠাৎ ধারাশ্রী হাউমাউ করে কেঁদে মুখ ঢাকল শাড়ির আঁচলে। তারপর অনেকক্ষণ শুধু কাঁদল। পিপুল ভ্যাবাচ্যাকা।
কান্নার পর যে ধারাশ্রী মুখ তুলল সে অন্যরকম–দুঃখী, নরম, অনুতপ্ত। পিপুলের দিকে চেয়ে বলল, তুমি কি কিছুই জান না পিপুল?
পিপুলও অনুতপ্ত। বিনয়ী গলায় বলল, এটা মফস্সল। এখনও এখানে কেউ কিছু শোনেনি।
রণেশ তোমাকেও বলেনি কখনো?
না। বিশ্বাস করুন।
করছি। কাউকে বিশ্বাস করা আমার এখন বড্ড দরকার। রণেশ ব্যাংকের আমার অ্যাকাউন্টে প্রায় চার লাখ টাকা ট্রান্সফার করেছে। কলকাতার বাড়ি আমার নামেই ছিল, এখনও আছে। রণেশ দাবি তুলবে না। তার বদলে সে মুক্তি চাইছে–রণিতাকে বিয়ে করবে।
পিপুল চুপ করে রইল। তার মনে পড়ল, রণেশ তাকে মাঝে মাঝে বলত, পুরুষমানুষদের, বিশেষ করে শিল্পীদের একজন মাত্র মহিলা নিয়ে থাকা অসম্ভব। প্রকৃতির নিয়ম এরকম নয়।
ধারাশ্রী বলল, রণিতা ওর হাঁটুর বয়সি। এমন কিছু সুন্দরী কী তুমিই বলো!
পিপুল দেখেছে, রণিতা খুব সুন্দরী না হলেও মুখশ্রী ভারি মিষ্টি। কালোর ওপর ছিপছিপে ছোটোখাটো চেহারা। চোখে সমসময়ে একটু অবাক দৃষ্টি।
পিপুল মাথা নেড়ে বলে, না, তেমন সুন্দরী নয়।
তাহলে? তাহলে ও এরকম করল কেন?
আপনি অস্থির হবেন না কাকিমা।
ধারাশ্রী অবাক হয়ে বলে, হব না! কী বলছ? আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, তবু অস্থির হব না?
পিপুল নম্র গলায় বলে, রণেশ কাকা কিন্তু এখানে কখনো কোনো বাড়াবাড়ি করেননি। আপনমনে ছবি আঁকতেন। কখনো কখনো আমার সঙ্গে বসে ছবি নিয়ে কথা কইতেন।
তুমি হয়তো সব জান না। ওদের মাখামাখি এখানেও হত। অবশ্য সেটা জেনেই-বা আর আমার লাভ কী? আমার যা সর্বনাশ হওয়ার তো হয়েই গেছে।
কিন্তু রণেশকাকা তো এখন প্যারিসে!
সেখান থেকেই খবর আসছে। কয়েকদিন আগে রণেশ একটা চিঠি লিখেছে আমাকে। তাতে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করেছে। যদি না ভাঙি, তাহলে ও রণিতাকে নিয়ে আলাদা থাকবে।
আপনি রণেশকাকাকে কী লিখলেন?
কিছু লিখিনি। উকিলের সঙ্গে কথা বলেছি। উকিল বলেছে, বিয়ে যদি আমি ভাঙতে না চাই, তাহলে ও কিছু করতে পারবে না। কিন্তু তাতে কী লাভ বল! তুমি এখনও তেমন বড়ো হওনি, তোমার কাছে বলতে লজ্জা করে। তবু বলি, আমার রূপ নেই, ছবি আঁকতে পারি না, ছবি বুঝিও না, বয়সও হচ্ছে–কী দিয়ে রণেশকে বেঁধে রাখব বলো তো? বিয়ে না ভাঙলেই কী আর ও বশ মানবে?
পিপুল খুব সংকোচের সঙ্গে বলে, রণেশকাকা তো এমনিতে বেশ ভালো লোক।
সে তোমাদের কাছে। আমি ওর স্ত্রী, আমার চেয়ে ভালো আর ওকে কে জানে!