তাতে কী হল? তুমি তো আমার খোঁজও নাওনি?
কেন, আমি শ্রীপদকে পাঠাইনি চিঠি দিয়ে তোকে নিয়ে যেতে? তোর দিদিমাই তো তোকে আটকে রেখেছিল।
দিদিমা তো ভালোই করেছিল। শ্রীরামপুরে গিয়ে কী হত? সবাই মিলে মারধর করে, খেতে-পরতে দেয় না, সব সময়ে গালাগাল করে।
ছেলেপুলেকে শাসন সবাই করে–ওটা ধরতে নেই।
গত চার বছরে তুমি তো আর আমার খোঁজ নাওনি!
হরিশচন্দ্র মৃদু মৃদু হেসে বলল, খোঁজ নিইনি কে বলল? এখানে আমার মেলা চর আছে। তারা ঠিক খবর দিত। তবে নিজে আসতাম না অপমানের ভয়ে। তা ছাড়া তোকে নিয়ে গিয়ে সৎমার হাতে ফেলতেও ইচ্ছে যায়নি। এ মাগীও বড্ড বদরাগী। তা তুই কি রেগে আছিস আমার ওপর বাবা?
পিপুলের চোখে জল আসছিল। বাবাকে সে ভালোবাসে না তেমন, তবু এই ভাঙাচোরা লোকটাকে দেখে তার কষ্ট হয়। মিথ্যেবাদী, পাজি, নিষ্ঠুর, মমতাহীন, মাতাল, স্বার্থপর এ লোকটা তার বাবা না হলে সে হয়তো খুশি হত। কিন্তু এ লোকটাকে একেবারে মুছেও তো সে ফেলতে পারেনি।
পিপুল বলল, বাবা বাড়ি যাও। মায়ের গয়না দিদিমা লুকিয়ে রেখেছে, কেউ তা খুঁজে বের করতে পারবে না।
হরিশচন্দ্র এবার তেরিয়া হয়ে বলে, এঃ, লুকিয়ে রাখলেই হল? দেশে আইন নেই? পুলিশ নেই?
পিপুল বলল, অত সব আমি জানি না। গয়না দিদিমা তোমাকে দেবে না।
তাহলে তুই আমার সঙ্গে চল!
কেন যাব?
তুই গেলে ওই বুড়ি নরম হয়ে পড়বে। নাতির মায়া বড় মায়া। সুড়সুড় করে গয়না বের করে দেবে তখন।
আমি শ্রীরামপুর যাব না।
আহা, বেশিদিনের জন্য বলছি না। সাতটা দিন একটু থেকে আসবি চল, তার মধ্যেই আমি বুড়িকে পটিয়ে মাল বের করে নেব।
পিপুল মাথা নেড়ে বলল, না বাবা, তুমি বাড়ি যাও। আমি তোমার সঙ্গে যাব না, দিদিমার কাছেই থাকব।
আজ বুঝি আমার চেয়েও দিদিমা তোর আপন হল! আমি যে ওদিকে না খেয়ে মরছি!
তুমি তো চাকরি কর।
সে চাকরি কবে চলে গেছে।
কালীমামা তোমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল না?
সেসব কবে ফুঁকে দিয়েছি। পাঁচ হাজারের অর্ধেকই তো গুন্ডাটা কেড়ে নিল। ক-টা টাকাই বা পেয়েছিলাম। দে বাবা এ যাত্রাটা উদ্ধার করে।
আমি তো গয়নার খবর জানি না–আমি পারব না।
হরিশচন্দ্র খুবই হতাশ হল। গয়নাগুলোই ছিল তার শেষ আশাভরসা। সে উবু হয়ে বসে পড়ল মাটিতে। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থেকে কাহিল গলায় বলল, তাহলে একটা কাজ করবি বাবা?
কী কাজ?
তোর দিদিমাকে গিয়ে বল গে, আমার অবস্থা এখন-তখন। দু-শোটা টাকা চাই। না, দাঁড়া –দু-শো নয়, চাইলে একটু বেশিই চাইতে হয়, কষাকষি করে ওই দু-শোই দেবে–তুই পাঁচ-শো চাস।
শোনো বাবা, তুমি আবার এসেছ শুনলে এবার কিন্তু মামারা তোমাকে ছাড়বে না। সবাই খুব রেগে আছে তোমার ওপর।
হরিশচন্দ্র কেমন ক্যাবলাকান্তের মতো ছেলের দিকে চেয়েছিল। কথাটা যেন বুঝতে পারল না। বলল, টাকাটা এনে দিলেই চলে যাব। তোর দিদিমার অনেক টাকা। দিদিমা যদি না দিতে চায়, দাদুকে বলিস। শ্বশুরটা খুব কেপ্পন ছিল বলে তার কাছে চাইতে ইচ্ছে যায় না। তবে শাশুড়িটা খুব খারাপ ছিল না। শালা-সম্বন্ধীরা ছিল এক নম্বরের খচ্চর। যা বাবা, ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আয়। নাহলে বেঘোরে মারা পড়ব।
পিপুল শেষ অবধি গিয়েছিল দিদিমার কাছে। সব কথা খুলে বলেছিল।
দিদিমার মনটা বড়ো নরম। জামাইয়ের অবস্থা শুনে চোখ দুটো ছলছল করতে থাকে। বলে, কিছু চাইছে বোধহয়?
প্রথমে দু-শো টাকা চেয়েছিল। পরে বলল, পাঁচ-শো। বলল, কষাকষি করে ওই দু-শোই দেবে।
দিদিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তার চরিত্র ভালো নয়, আবার বিয়ে করে আর একটা মেয়ের সর্বনাশ করেছে। সংসারে টান পড়ায় এসে হাজির হয়েছে। টাকা কিছু দিতে পারি, তবে ভয় হয় টাকা নিয়ে গিয়ে মদ গিলে পড়ে থাকবে হয়তো।
তাহলে বলে দিই যে হবে না!
না, একেবারে শুধু হাতে ফেরানোর দরকার নেই। পঞ্চাশটা টাকা দিচ্ছি, দিয়ে আয় গে, বলিস যেন মদটদ না-খায়।
পিপুল অবাক হয়ে বলল, দেবে?
যদি কষ্ট পায়।
বাবাকে আমি চিনি দিদিমা, টাকা পেলেই মদ খাবে।
তা কপালে কষ্ট লেখা থাকলে আর কী করা যাবে! যা দিয়ে আয়।
পিপুল পঞ্চাশটা টাকা এনে দিলে। হরিশচন্দ্র পাওনাগন্ডা বুঝে নেওয়ার মতো স্বাভাবিক ভাবেই টাকাটা পকেটে রাখল। যেন হকের টাকা। বলল, এ বাজারে পঞ্চাশে কিছু হয়? তোর দিদিমার নজরটা বড়ো ছোটো। আমি আজ যাচ্ছি–ফের আসব সামনের হপ্তায়। এর মধ্যে গয়নাগুলোর একটা খোঁজখবর করে রাখিস।
৪. পিপুল লজ্জার মরে গেল
রণেশের সঙ্গে তার বউয়ের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। তার মস্ত কারণ একটা মেয়ে। আর্ট কলেজের এই ছাত্রীটি রণেশের সঙ্গে খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে একটা বিশেষ কারণে। মেয়েটির বাবা প্রভাবশালী লোক। তাঁর সহায়তায় রণেশ প্যারিসে একটা এক বছরের বৃত্তি পায় এবং বিদেশে প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা হয়। রণেশ যখন বিদেশে যায় তখন মেয়েটাও আগেভাগে গিয়ে প্যারিসে বসে আছে। শোনা যায়, সেখানেই তাদের মেলামেশা মাত্রা ছাড়াতে শুরু করে। রণেশ প্যারিসে থাকে এক বছর। এক বছরে মেয়েটি অন্তত তিনবার প্যারিসে যায়।
এসব খবর চাপা থাকে না। পল্লবিত হয়ে এদেশেও এসে পৌঁছোয়। রণেশের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি এবং তৎসহ পয়সা বেড়েছে। পোশাক বদলেছে। সবচেয়ে বেশি বদলেছে মেজাজ। রণেশ চল্লিশোর্ধ্ব। এ বয়সে কাঁচা মেয়ের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা যেমন রোমাঞ্চক তেমনি বিপজ্জনক।