পিপুল অখন্ড মনোযোগে পড়ে, একই মনোযোগে ব্যায়াম করে এবং ছবিও আঁকে। সে একটু একটু বুঝতে পারে, এ দুনিয়ায় তাকে ঠেকনো দেওয়ার মতো আপনজনের বড়োই অভাব। দাদু আর দিদিমা তাকে যক্ষীর মতো আগলে থাকে বটে, কিন্তু তাদের দিন ফুরিয়ে আসছে। বাবা মাতাল এবং কাকা আর কাকিমার সংসারে তার অবস্থান অনিশ্চিত। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে একটু বড়ো হতে হবে। বড়ো না হলে এ দুনিয়াটার সঙ্গে যুঝতে পারবে না সে।
ইস্কুলে তার অনেক বন্ধু জুটে গেল। পাড়ায় জুটল। অনেক মানুষের সঙ্গে তার চেনাজানা হল। যে লোকটা তাকে কালীমামার হাত থেকে প্রথম রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিল সেই গৌর মিত্তিরের সঙ্গে তার দারুণ ভাব হয়ে গেল। কারণ গৌর মিত্তিরের আখড়াতেই সে ব্যায়াম শেখে। বাঘা চেহারা, দারুণ দাপট, প্রবল অহংকার। পিপুলের বুকে একটা প্রবল থাবড়া কষিয়ে একদিন বলল, শুধু চেহারা বাগালেই হবে না, ওতে শরীর সর্বস্ব হয়ে পড়বি। শুধু শরীর-শরীর করে স্বার্থপর, ভীতু আর বোকা হয়ে যাবি। সঙ্গে সাহস, স্বার্থত্যাগ এসবও চাই।
পিপুল করুণ গলায় বলে, ওসবের জন্যও কি আখড়া আছে?
গৌর হাঃ হাঃ করে খুব হাসল। বলল, তুই বেশ ত্যাঁদড় আছিস তো। বোকা তো নোস দেখছি! ব্যায়ামবীরদের বড় একটা সেন্স অফ হিউমার থাকে না–তোর আছে। খুব খুশি হলুম রে।
পিপুলও খুশি হয়ে বলে, আমি ওরকম মোটেই হতে চাই না। আমি ছবি আঁকব বলেই ব্যায়াম করছি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ছবি আঁকাও খুব ভালো। গান গাইতে পারিস?
জানি না। কখনো গাইনি।
শুনতে ভালোবাসিস?
হ্যাঁ।
তাহলেই হবে। একখানা গা দেখি।
সন্ধ্যের পর ব্যায়ামাগার প্রায় ফাঁকা। শরৎকালে সন্ধ্যের পর একটু হিম পড়ছে। আদুড় গায়ে একটা তোয়ালে জড়িয়ে বেঞ্চের ওপর বসা গৌর মিত্তিরকে দেখলে বোম্বেটে বলে মনে হলেও লোকটা মোটেই ওরকম নয়। কিছুক্ষণ পিপুলকে অনুরোধ করেও যখন গাওয়াতে পারল না, তখন নিজেই খোলা গলায় একখানা রাগাশ্রয়ী শ্যামাসংগীত ধরে ফেলল গৌর মিত্তির। গাইতে গাইতে চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এল।
পিপুল মুগ্ধ। বলল, আমাকে গান শেখাবেন?
শেখাব। তবে সব কিছু একসঙ্গে করতে যাস না–সব পন্ড হবে। কোনটা বেশি ভালো লাগে সেটা ভালো করে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখিস। যেটা বেশি ভালো লাগবে সেটাতেই জান লড়িয়ে দিবি।
পিপুলের জীবন শুরু হল ছবি, গান, শরীরচর্চা দিয়ে। জীবনের স্বাদ সে এই প্রথম পাচ্ছে। ছুটছাট গন্ডগোল মামাবাড়িতে লেগেই আছে বটে, কিন্তু পিপুল আর গ্রাহ্য করে না।
দিদিমা একদিন বলল, হ্যাঁরে দাদা, তুই যে বেশ জোয়ানটি হয়ে উঠলি। এই তো ছোট্টটি এসে হাজির হয়েছিলি গুটিগুটি!
সে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, খুব খাওয়াচ্ছ যে! পেটভরে এতকাল কী খেতে পেতুম?
আর একদিন আরও মজার একটা ঘটনা ঘটল। সন্ধ্যেবেলা ব্যায়ামাগার থেকে ফিরছিল পিপুল। বিকেলের আলো তখনও একটু আছে। বাড়ির সামনের পুকুরের ধারে কদম গাছের তলায় একজন লোক বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। পিপুল তাকে এক লহমায় চিনতে পারল। তার বাবা হরিশচন্দ্র। কিন্তু বিস্ময়ের কথা, তার বাবা তাকে একদম চিনতে পারল না। বরং তাকে দেখে বলল, তুমি ও বাড়িতে যাচ্ছ ভাই?
পিপুল বাবাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। প্রশ্ন শুনে হাঁ হয়ে গেল। বলল, হ্যাঁ তো, কিন্তু…
আমাকে চিনবে না। ও বাড়িতে একটি ছোটো ছেলে আছে, তার নাম পিপুল–একটু ডেকে দেবে তাকে?
পিপুল এত অবাক হল যে বলবার নয়। কিন্তু সে একটু বাজিয়ে নেওয়ার লোভও সামলাতে পারল না। বলল, আপনি পিপুলের কে হন?
হরিশচন্দ্রের চেহারা অনেক ভেঙে গেছে। দু-গাল গর্তে, চোখ ডেবে গেছে। জামাকাপড়ের অবস্থাও ভালো নয়। হরিশচন্দ্র যে কিছু একটা মতলবে এসেছে তাতে সন্দেহ নেই। হরিশচন্দ্র বলল, বিশেষ কিছু হই না–দেশের লোক আর কী!
পিপুল তার বাবার কথা খুব জিজ্ঞেস করে, আপনি কী তার বাবার কাছ থেকে আসছেন?
হ্যাঁ, ওরকমই।
আপনি কি তাকে নিয়ে যেতে চান?
হরিশচন্দ্র মলিন মুখে মাথা নেড়ে বলে, না। কোথায় নেব? আমার জায়গা নেই!
পিপুলকে কিছু বলতে চান?
হরিশচন্দ্র ইতস্তত করে বলে, একটা দুটো কথা ছিল। তা তাকে কি পাওয়া যাবে এখন?
যান না, ভিতরে চলে যান। সে দোতলায় থাকে।
হরিশচন্দ্রের সে সাহস হল না। জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, ভিতরে আর যাব না, এখান দাঁড়িয়েই দুটো কথা কয়ে নেব। সময় লাগবে না।
বাবার প্রতি পিপুলের তেমন কোনো আকর্ষণ কোনো দিনই ছিল না। বাবার জন্যই তার মা আত্মহত্যা করেছে। এই বাবার জন্যই সে নিজেদের বাড়িতে শতেক লাঞ্ছনা সহ্য করেছে। এই বাবাই তাকে মামাবাড়িতে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল গয়নার লোভে। সুতরাং বাবার ওপর তার খুশি হওয়ার কারণ নেই।
সে বলল, কেন, ভিতরে যাবেন না কেন?
হরিশচন্দ্র থুতনি চুলকে বলল, না, আমার জামাকাপড় তো ভালো নয়। এ পোশাকে কী আর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া যায়!
শ্বশুরবাড়ি কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। পিপুল হেসে ফেলল, বলল, এটা আপনার শ্বশুরবাড়ি নাকি?
হরিশচন্দ্র জিব কেটে বলল, না, ঠিক তা নয়। অনেক দূর-সম্পর্কের একটা ব্যাপার ছিল তো, তাই।
পিপুল নাটকটা আর বাড়াতে দিল না। একটু হেসে বলল, এতগুলো মিথ্যে কথা কেন বলছ বাবা? আমিই পিপুল।