কথা কইতে হয় কী সাধে। এই শেষ কথা কটা না বলে নিলেই নয়–ঋণ রেখে মরা কী ভালো?
গয়না কত ভরি আছে?
সে কী আর জানি। কিছু গয়না জামাই ভেঙে খেয়েছে। বাকিগুলো রক্ষা করতে আমার কাছে রেখে গিয়েছিল। যক্ষের মতো আগলে রেখেছি এতকাল। আর কী পারব? যার ধন তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে এইবেলা।
আর কথা বোলো না। তোমার হাঁফ ধরে যাচ্ছে। গয়নার বিলিব্যবস্থা করব, চিন্তা কোরো না।
ডাক্তারকে আর ডাকতে হবে না। তুমি নিজেই বরং একটু করে হোমিও ওষুধ দাও। যা হওয়ার তাতেই হবে।
আমারও কী বুদ্ধি কাজ করছে এখন? হোমিওপ্যাথি করতে স্থির বুদ্ধি চাই। আমার তো হাত কাঁপছে। ফোঁটা বা বড়ি ফেলতে পারছি না। ওষুধও ঠিক করতে পারছি না।
ওতেই হবে। তুমি যা দেবে তাতেই আমার কাজ হবে।
আচ্ছা, তাই হবে।
দিদিমা চোখ বুজল।
পিপুলের পৃথিবী দিদিমার সঙ্গেই যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারে, দিদিমা না বাঁচলে তার পক্ষে বেঁচে থাকা বড়ো কঠিন হবে।
দিদিমা ঘুমোলে দাদু তাকে নিয়ে ছাদে এল। পায়চারি করতে করতে বলল, শুধু গয়না নয়, এ বাড়ি বা সম্পত্তিতেও তোর ভাগ আছে।
করুণ গলায় পিপুল বলে, ভাগ চাই না দাদু। এ বাড়িতে আমাকে কেউ দেখতে পারে না। আমি শ্রীরামপুরে ফিরে যাব।
দাদু মাথা নেড়ে বলে, সে যাস। তবু কথাগুলো তোকে বলে রাখলাম। দিদিমা তোকে বড়ো ভালোবাসে, এখনই যদি চলে যাস তবে বুড়ি বোধহয় হার্টফেল করবে। এখন কয়েকটা দিন কষ্ট করে থাক, তোর দিদিমা একটু সুস্থ হলে আমি নিজে গিয়ে তোকে শ্রীরামপুর স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসব।
এ প্রস্তাবে আপত্তি নেই পিপুলের। দিদিমা আর দাদুকে ছেড়ে যেতে তার যে খুব ইচ্ছে করছে তাও নয়। কিন্তু এ বাড়িতে তো থাকাও যায় না। বড়ো অশান্তি তাকে নিয়ে।
দিদিমা অবশ্য বেঁচে রইল। মরতে মরতেও শেষ অবধি মরল না। পরদিন সকাল বেলায় একটুক্ষণের জন্য উঠেও বসল এবং একটু দুধ খেল। ডাক্তার এসে দেখেটেখে বলল, হার্ট অ্যাটাক বলে ভেবেছিলাম। লক্ষণও তাই ছিল। তবে বোধহয় সিরিয়াস কিছু নয়। অল্পের ওপর দিয়ে ফাঁড়া কেটে গেছে।
দাদু একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বাঁচালে ডাক্তার। লক্ষণ দেখে আমার তো হাত পা হিম হয়ে গিয়েছিল।
ডাক্তার প্রেসারের যন্ত্র আর স্টেথস্কোপ গুছিয়ে ফেলে বলল, আপনাদের বাড়িতে কী একটা হাঙ্গামা হয়েছিল কাল। তাই না? ওরকম কিছু আবার হলে কিন্তু অ্যাটকটা রেকার করবে। কোনোরকম উত্তেজনা একদম বারণ।
আর ওরকম হবে বলে মনে হয় না।
তবু সাবধানে রাখবেন।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর দাদু দিদিমাকে বলল, নীচে শুনে এলাম, কাল রাতে নাকি স্টেশনে গিয়ে হরিপদ আর পাড়ার মাতব্বররা হরিশচন্দ্রের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মিটমাট করে এসেছে।
দিল?
না দিয়ে উপায় কী? জামাই যা একখানা খুনে ঠ্যাঙাড়েকে পাঠিয়েছিল, ভয়ে সবাই জল! দুনিয়াটা হল শক্তের ভক্ত আর নরমের যম।
টাকাটা দিল কে?
কালীপদকেই দিতে হয়েছে। মারধরে সে-ই তো পান্ডা ছিল কিনা, তবে ভয়ে সে নিজে যায়নি। হরিপদ এসে নাকি বলেছে যে, জামাই আর তার দলবল সব স্টেশনেই মাইফেল বসিয়ে ফেলেছিল। সব নাকি মদে চুর। টাকা পেয়ে জামাই নাকি হরিপদর থুতনি নেড়ে চুম খেয়ে বলেছে, যাও তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম। আমার ছেলেটাকেও তোমাদের দান করে দিলাম। তার অযত্ন কোরো না, তাহলে ফের হাঙ্গামায় পড়ে যাবে।
দিদিমা চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সবই আমার কপাল। তবু নাতিটাকে তো রাখতে পারব। সেটাই আমার ঢের।
দেখো কতদিন রাখতে পার! টাকাপয়সা দিয়ে আপোশরফার ফল ভালো হয় না। টাকায় টান পড়লে জামাই ফের আসবে। ব্ল্যাকমেল বোঝো? এ হচ্ছে সেই ব্ল্যাকমেল।
কালী তার পাপের শাস্তি পাচ্ছে। আমরা কী করব বল।
৩. রণেশের সঙ্গে পিপুলের ঘনিষ্ঠতা
রণেশের সঙ্গে পিপুলের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠতে লাগল ছবি নিয়েই। ইস্কুল আর পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে রণেশের কাছে চলে আসে। ড্রয়িং শেখে, রঙের সঙ্গে রং মেশাতে শেখে, ক্যানভাসে তুলি চালাতে শেখে। রণেশ তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, খেলাধুলো করিস?
একটু-আধটু।
দুর বোকা! একটু-আধটু করলে হয় না। রীতিমতো শরীরচর্চা করতে হয়। আর্টিস্টের বেসিক স্বাস্থ্য হওয়া দরকার চমৎকার। স্বাস্থ্য ভালো হলে অনেকক্ষণ একনাগাড়ে কাজ করতে পারবি, হাতে বা ঘাড়ে যন্ত্রণা হবে না, পিঠ টনটন করবে না। আরও কথা আছে। শিল্প হল বসে বসে কাজ। ব্যায়ামট্যায়াম না করলে ব্লাড-সুগার হয়ে যেতে পারে। দেখিসনি দ্য ভিঞ্চি বা পিকাসোর কেমন স্বাস্থ্য ছিল। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরি তো কুস্তিগীর ছিলেন। ভালো আর্টিস্ট হতে হলে কোনো ব্যায়ামগারে ভরতি হয়ে শরীরটাকে ঠিক কর।
আর্টিস্ট হওয়ার জন্য পিপুল সব কিছু করতে রাজি। রণেশের কথায় সে একটা ব্যায়ামাগারে ভরতি হয়ে গেল। অখন্ড মনোযোগে ব্যায়াম করতে লাগল।
মামাবাড়িতে শান্তি নেই, কিন্তু গোটা বাড়ি একদিকে আর দাদু দিদিমা ও পিপুল আর একদিকে হওয়ায় সম্পর্কটা কম। মাঝখানে একটা গোলযোগ হয়ে গেল। মামারা এক বাড়িতেই হাঁড়ি ভাগাভাগি করে নিল। আর সেই গন্ডগোলে দাদু আর দিদিমাও মূল সংসার থেকে বাদ পড়ে গেল। দিদিমা দোতলার দরদালানে উনুন পেতে আলাদা রান্নার ব্যবস্থা করে নিল। পিপুল যে রয়ে যেতে পারল, সেটাই বড়ো কথা।