তার মানে আপনারা উপুড়হস্ত হচ্ছেন না?
তোমার সঙ্গে কততে রফা করেছে হরিশচন্দ্র?
রফাটফা কীসের মশাই। সে আমার বন্ধু-লোক।
হরিপদ ফের হেসে বলে, এটা কলিকাল কিনা, ওসব শুনলে ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। হরিশচন্দ্র যদি পাঁচ হাজার পায়, তবে তুমি তা থেকে না হোক আড়াইটি হাজার নেবে। তাই না?
শ্রীপদ একটা হাই তুলে বলল, হরিশচন্দ্র তো স্টেশনেই বসে আছে। কথাবার্তা তার সঙ্গেই গিয়ে বলে আসুন না। জেনে আসুন কার কত বখরা।
বাপু হে, টাকাটা যদি দিই তাহলে গলা বাড়িয়ে নিজের দোষ কবুল করা হয়। আমরা ও ফাঁদে পা দিচ্ছি না। তুমি আসতে পার।
কাজটা বোধহয় ভালো করলেন না মশাই। বলে শ্রীপদ উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, হরিশচন্দ্রের ছেলেকে আমি সঙ্গে নিচ্ছি না। ওর দিদিমার বড়ো মায়া ওর ওপর। তবে আপনারা যদি পৌঁছে দেন কখনো, দেবেন।
এই বলে শ্রীপদ মন্ডল বেশ দুলকি চালে চলে গেল।
হরিপদর সাহস দেখে সবাই অবাক। সন্ত্রস্ত কালীমামা বারবার বলতে লাগল, কাজটা ঠিক হল না–কাজটা ঠিক হল না। লোকটা মোটেই সুবিধের নয়।
উত্তেজিত কালীমামার হঠাৎ নজর পড়ল পিপুলের দিকে। পিপুল তার দিদিমার গা ঘেঁষে তখনও দরদালানের বাইরের বারান্দামতো জায়গাটায় দাঁড়ানো। কালীমামা পিপুলের ওপর চোখ পড়তেই শক-খাওয়া লোকের মতো লাফিয়ে উঠে বলল, ওই ছোঁড়াই যত নষ্টের গোড়া! আর মায়েরও বলিহারি যাই, একটা অজ্ঞাতকুলশীলকে একেবারে ঘরদোরে বিছানা অবধি নিয়ে তুলেছে! অ্যাই ছোঁড়া, এখনই বার হ বাড়ি থেকে!
দিদিমা তাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। দিয়েই হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, তোকে যে এখন কোথায় রাখি দাদা। আমার মাথাটা বড় কেমন কেমন করছে।
বলতে বলতেই দিদিমা ঢলে পড়ল মেঝের ওপর। পিপুল তাড়াতাড়ি গিয়ে না ধরলে মেঝের ওপর পড়ে মাথাটা ফাটত।
ও দিদিমা! ও দিদিমা! বলে ডাকাডাকি করতে থাকে পিপুল।
দিদিমা একবার চোখ খুলে খুব ক্ষীণ গলায় বলে, বুকে ব্যথা হচ্ছে, তোর দাদুকে ডাক… পিপুল দিদিমাকে তুলে যে বিছানায় শোয়াবে ততখানি জোর তার শরীরে নেই। তবে বুদ্ধি করে সে মেঝের ওপর একটা মাদুর বিছিয়ে বালিশ পাতল। তারপর দিদিমাকে গড়িয়ে নিয়ে সে মাদুরের ওপর শোওয়াল।
পিপুল চেঁচামেচি করল না, ঘাবড়েও গেল না। নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরোলো। নীচে অবশ্য চেঁচামেচি বন্ধ হয়েছে, কিন্তু দরদালানে খুব উত্তেজিত গলা পাওয়া যাচ্ছে কয়েকজনের। একটা লোক বাড়ি বয়ে এসে অপমান করে গেছে, ব্যাপারটা সহজ নয়। পাড়ার লোকজনও কিছু জুটেছে, আরও আসছে।
দাদুকে সিঁড়ির গোড়ায় পেয়ে গেল পিপুল। কানে কানে খবরটা দিতেই দাদু ফ্যাকাশে মুখে উঠে এল ওপরে। দিদিমার নাড়ি ধরেই বলল, গতিক সুবিধের নয়। তুই শিয়রে বসে মাথায় হাওয়া দে।
এক ডোজ হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিদিমার মুখে ঢেলে দিয়ে দাদু বেরিয়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনল।
তারপর দিদিমাকে নিয়ে পরদিন সকাল অবধি যমে-মানুষে টানাটানি। পিপুলের দিকে কেউ নজর দিল না তেমন।
শেষরাতে পিপুল ঘুমিয়েছিল একটু, যখন চোখ চাইল তখন তার চোখের কোণে জল। ঘুমের মধ্যেও সে কেঁদেছে। বুক বড়ো ভার। ইহজীবনে এই দিদিমার কাছেই সে আদরের মতো একটা জিনিস পেয়েছিল কয়েকদিন। সেই আদরের দিন কী তবে ফুরোল?
দিদিমা অবশ্য মরল না। সামলে উঠল।
দুপুর বেলা দিদিমা তাকে ডেকে চুপিচুপি বলল, আমার মনে হয় এ যাত্রা আর খাড়া হব না। ঋণ রেখে যেতে নেই। ভালো করে শোন। ওই যে উঁচু কাঠের আলমারি দেখছিস, ওর মাথায় রাজ্যের ডাঁই করা বাজে জিনিস আছে। পুরোনো কৌটো, ন্যাকড়ার পুঁটুলি এইসব। খুঁজলে দেখবি ওর মধ্যে একটা পুরোনো বড়ো কৌটো আছে–তার মধ্যে তোর মায়ের গয়না।
গয়না দিয়ে কী হয় তা পিপুল জানে না। গয়না দামি জিনিস হতে পারে, কিন্তু তার কোন কাজে লাগবে? সে বলল, আমার গয়না চাই না দিদিমা, তুমি ভালো হয়ে ওঠো।
চাই না বললেই তো হয় না। জিনিসটা তোর। তবে ও নিয়ে বিপদে পড়বি। তোর দাদুকে ডাক, তাকে বলছি।
দাদু কাছেই ছিল, ডেকে আনল পিপুল।
দিদিমা অবসন্ন শরীরের হাঁফধরা গলায় বলল, গয়নার খবর ওকে দিয়েছি। তুমি ওগুলো বেচে ওর একটা ব্যবস্থা করে দিও।
দাদু হতাশ গলায় বলে, কী ব্যবস্থা করতে বলছ?
গয়নাগুলো বিক্রি করে যা টাকা পাবে সেটা ওর নামে ডাকঘরে রাখলে কেমন হয়?
ও তো এখনও ছোটো। গার্জিয়ান ছাড়া টাকা তুলতে পারবে না।
তোমরা পুরুষমানুষ, ভেবে একটা কিছু বের করো। ওর কাছে গয়না থাকলে হয় মামারা কিংবা ওর বাবা কেড়ে নেবে।
সে তো বটেই। তুমি অত হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? মনটা শক্ত করো–বেঁচে উঠবে। ডাক্তার তেমন কোনো ভয় দেখায়নি।
ডাক্তাররা কী বোঝে আমার শরীরের ভিতরে কী হচ্ছে। যদি মরি তাহলে পিপুলের জন্য বড়ো অস্থির মন নিয়ে যাব। আমার মনটাকে একটু শান্ত করে দাও।
একটু ঘুমোও। আমারও নানা অশান্তিতে মাথা ভালো কাজ করছে না। তোমাকে সুস্থ করে তুলতে না পারলে আমার অবস্থা কী হবে একবার ভেবে দেখেছ?
দেখেছি। আমি গেলে এ সংসারে তুমি বড়ো বালাই। কিন্তু কী করব বল, ভগবানের ওপর তো আমাদের হাত নেই।
ওভাবে বোলো না, আমার বুকের জোর-বল চলে যায়। ডাক্তার তোমাকে বেশি কথা কইতে বারণ করেছে।