- বইয়ের নামঃ পিপুল
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. পিপুলের জীবনটা
পিপুল – উপন্যাস – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পিপুলের জীবনটা নানা গন্ডগোলে ভরা। সেই সব গন্ডগোলের বেশির ভাগই সে নিজে পাকায়নি, কিন্তু তাকে নিয়ে গন্ডগোল পাকিয়ে উঠেছে। তার মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সে তার মা গলায় দড়ি দিয়ে মরে। বলাই বাহুল্য মায়ের আত্মহত্যার পিছনে প্রত্যক্ষ হাত না থাক, পরোক্ষ ইন্ধন ছিল তার মাতাল ও ফুর্তিবাজ বাবার। কিন্তু কিছু লোক থাকে, এমনিতে খুব গভীরভাবে খারাপ নয়, কিন্তু স্বভাবের চুলকুনির ফলে নানা অকাজ করে ফেলে। পিপুল যতদূর জানে, তার বাবা ভীতু ধরনের লোক, বউকে যথেষ্ট ভয় খেত এবং রোজ মদ ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করত। নিরীহ হলেও মদ খেলে লোকটা একেবারে বাঘ হয়ে উঠত, তখন হম্বিতম্বি ছিল দেখার মতো। যাই হোক, নিত্য মদ নিয়ে এবং মদজনিত অশান্তি ছাড়াও সংসারে আরও বিস্তর খটামটি ছিল। সেসব অভাবজনিত নানা আক্রোশ আর ক্ষোভের প্রকাশ। তা ছাড়া দুই পরিবারের মধ্যেও বড়ো একটা সদ্ভাব ছিল না। বিয়ের সময়ে দানসামগ্রী ইত্যাদি এবং মেয়ের বাড়ির একটা গুপ্ত কলঙ্ক নিয়ে বিস্তর ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল। ফলে পিপুলের সঙ্গে তার মামাবাড়ির সম্পর্ক ছিল না।
মা মরার পর, মামারা পুলিশ নিয়ে এসে বাড়ি ঘিরে তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। পিপুলদের লোকবল, অর্থবল বিশেষ ছিল না। তবে তার ঠাকুর্দা এবং একমাত্র কাকা উকিল টুকিল লাগাল ঘটিবাটি বেচে। তার বে-আক্কেলে বাবা ছাড়া পেয়ে দিগ্বিজয়ীর মতো হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরল। যার বউ সবে মরেছে তার যে হাসিখুশি হওয়া উচিত নয় এই বুদ্ধিটুকুও কেউ দেয়নি তাকে। এই সহজে রেহাই পাওয়া ইদানীং হলে হত না। ইদানীং বউ মরলে স্বামীকে দেশছাড়া হতে হয়, নইলে থানা-পুলিশ নাকাল করে মারে। তার বাবা অল্পের ওপর দিয়ে ফাঁড়াটা কাটিয়েই কদিন খুব ফুর্তি করল। তখন পিপুল তার কাকিমার কাছে খানিকটা লাথি-ঝাঁটা খেয়েই পড়ে আছে। কাকিমার দোষ নেই, তার অনেক কটা ছেলেপুলে, অভাবের সংসার, তার ওপর মাতাল ভাশুর। পিপুল একটু দুষ্টুও ছিল বটে, কাকা দাদু বাবা সবাই তাকে প্রায় পালা করে পেটাত।
এইভাবে সে তার জীবনের গন্ডগোলগুলো টের পেতে শুরু করে।
মা-মরা ছেলেদের অনেক সমস্যা থাকে। পিপুলেরও ছিল। কিন্তু সে-সব গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছিল তার। সংসারে কারো কাছে ভালো ব্যবহার পেত না বলে ঘরের চেয়ে বাইরেটাই ছিল তার প্রিয়। সারাদিন স্কুল ছাড়া তাকে দেখা যেত রাস্তায় ঘাটে, নদীর ধারে, মাঠে জঙ্গলে।
ওদিকে বাবার অবস্থা ক্রমশ সঙ্গিন হয়ে উঠছে। টাকা-পয়সা যা রোজগার করে তা উড়িয়ে দেয় হাজারো ফুর্তিতে। যে বাপ টাকা দেয় না, তার ছেলের দুর্দশা তো সবাই জানে। কাকা কাকিমা আর দাদু মিলে তাকে রোজ বিস্তর খারাপ কথা শোনাত।
একদিন পয়সার অভাবে তার বাবা তাকে কাজে লাগানোর একটা উদ্ভট চেষ্টা করেছিল।
সেটা রবিবারই হবে। সকাল বেলায় তার বাবা তাকে ডেকে খুব হাসি-হাসি মুখে বলল, ওরে পিপুল, মামাবাড়ি যাবি?
পিপুল অবাক হয়ে বলে, মামাবাড়ি! সেখানে কে আছে?
আছে রে আছে। তাদের মেলা পয়সা হয়েছে। যাবি?
গিয়ে?
গিয়ে? গিয়ে মামা, মামি, মাসি, দাদু, দিদাদের একটু পেন্নাম করে আসবি। তোর দিদিমা খুব ভালো লোক। খুব চুপিচুপি তোর দিদিমার কানে কানে একটা কথা বলবি। বলবি, তোর মায়ের গয়নাগুলো যেন তোর কাছে দিয়ে দেয়।
গয়না! বলে হাঁ করে চেয়েছিল পিপুল।
তোর মা গলায় দড়ি দেওয়ার আগে গয়নাগুলো সব সরিয়ে ফেলেছিল। মনে হয় তোর দিদিমার কাছেই গচ্ছিত রেখে এসেছিল। ওগুলো পেলে এখন আমরা বাপ-ব্যাটায় একটু খেয়ে-পরে থাকতে পারি। তোর মামাবাড়ির অনেক পয়সা। হাত ঝাড়লেই পর্বত। ছেঁড়া জামাটামা পরে নিস, তাহলে তাদেরও একটু মায়া হবে।
পরদিন ছেঁড়া আর ময়লা জামা পরিয়ে, খালি পায়ে হাঁটিয়ে তাকে নিয়ে তার বাবা শ্বশুরবাড়ি চলল। লোকাল ট্রেনে মিনিট পনেরোর পথ। স্টেশন থেকে রিকশায় অনেকখানি। মামাবাড়ি থেকে দু ফার্লং দূরে রিকশা থেকে নেমে পড়ল তারা।
বাবা বলল, ওই সোজা রাস্তা। একটু এগিয়ে প্রথম ডানহাতি রাস্তায় ঢুকলেই দেখতে পাবি, সামনে পুকুরওলা পুরোনো বাড়ি। সোজা ঢুকে যাবি ভিতরে।
পিপুল কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, কাউকে চিনি না যে!
দুর বোকা! চেনাচেনির কী আছে? গিয়ে বলবি আমি অমুকের ছেলে। আমার নামটা বলবার দরকার নেই, মায়ের নামটাই বলিস। মা-মরা ছেলে তুই, তোকে আদর-যত্নই করবে মনে হয়। তবে আদরে কাজের কথাটা ভুলে যাস না বাবা। গয়নার কথা মনে আছে তো! খুব চুপিচুপি দিদিমাকে বলবি, আর কাউকে নয়। আমি এই যে চায়ের দোকানটা দেখছিস, এখানেই থাকব। কাজ হয়ে গেলে এখানে এসে ডেকে নিবি। আর শোন, আমি যে সঙ্গে আছি একথা খবর্দার বলিস না কাউকে!
ব্যাপারটা ভালো করে বুঝে নিয়ে পিপুল অনিচ্ছের সঙ্গেই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। তার বুকটা দুরদুর করছিল। মামাবাড়ির কাউকেই সে ভালো চেনে না। কোন শিশুকালে মায়ের সঙ্গে আসত, কিছু মনেই নেই তেমন।
পুকুরওলা বাড়িটার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। ঢুকতে সাহস হচ্ছিল না। পুকুরের পাশ দিয়ে একটা ইট-বাঁধানো সরু পথ। সেই পথ একটা পুরোনো পাকা বাড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে। বাড়িটা বেশ বড়ো এবং দোতলা। লাল রঙের। বাগান আছে, কয়েকটা নারকেল আর সুপুরির গাছ আছে।