মদন চারদিকে চেয়ে বলে, এ ঘরটায় কী করে যে এতকাল আছেন আপনারা। একে একতলা, তাতে ছোট ঘরে গাদা জিনিসপত্র। এতদিনে একটা বাড়ি করার মতো টাকা আপনার হয়েছে জামাইবাবু।
সতীনের ছেলেকে সবাই মোটা দেখে। টাকা হত, যদি রাখা যেত।
মদন মাথা নেড়ে বলে, আপনার কিছু হবে না জামাইবাবু।
যা বলেছ।
তবু আপনি ভীষণ হ্যাপি।
আবার সেই সতীনপো-এর বৃত্তান্ত! পরের সুখই সকলের চোখে পড়ে।
চুল আঁচড়ে মদন ঘাড়ে গলায় একটু পাউডার দিল। বলল, আর কিছু না করুন, এবার একটা টেলিফোন লাগান। নইলে আমার ভারী অসুবিধে।
ঠিক আছে, অ্যাপ্লাই করব।
আপনাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমিই করবখন।
.
০৪.
ভুলে যাওয়ার এক অতুলনীয় ক্ষমতা আছে মদনের। আবার মনে রাখার ক্ষমতাও তার তুলনারহিত। দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশে সে জীবনের ফালতু ঘটনা, মানুষ বা কথাকে ভুলে যেতে পারে। যা তার প্রয়োজন তা প্রখরভাবে মনে রাখে।
ফিটফাট হয়ে যখন সে বাইরের ঘরে ঢুকল তখন সকালের অনেক ঘটনাই ভুলে গেছে। আবার বেশ কিছু ঘটনা তার মনেও আছে।
মনে রাখার মধ্যে আছে দুজন সাংবাদিক। আগাগোড়া দুই রিপোটার তার সঙ্গে লেগে আছে।
ঘরে ঢুকেই সে বলল, শচী, বলো খবর কী?
শচী লম্বা কালো মোগা এবং ধূর্ত। চারদিকে মিটমিটে চোখে চেয়ে নিয়ে হাসি-হাসি মুখে বলে, খবর তো আপনার কাছে দাদা।
ঘরের কথাবার্তা থেমে গেছে। সকলে এম পির দিকে তাকিয়ে। প্রাইম মিনিস্টার পর্যন্ত এঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেন।
মদন চারদিকের মনোযোগটাকে খুব উপভোগ করে। দরজার কাছে রোগা ও অল্পবয়সী জয় তার চা এখনও শেষ করতে পারেনি। এবার এক চুমুকে শেৰ আধপেয়ালা মেরে দিল।
মদন বলল, গত জুলাইয়ে মনসুন সেশনে আমি পালামেন্টে একটা বিলের ওপর খুব গুরুতর একটা প্রশ্ন তুলি। দিল্লি, এলাহাবাদ, বোম্বের কাগজে সেটা ফাস্ট পেজে ফ্ল্যাশ করে। তোমাদের কাগজে তার সামান্য উল্লেখ পর্যন্ত ছিল না। কেন শচী! বাঙালি এম পি বলেই কি তোমাদের এরকম মনোভাব?
শচী জিব কেটে বলে, ছি ছি। কে না জানে, আমরা বাঙালি লিভারদের সবচেয়ে বেশি কভারেজ দিই।
আমাকে দাওনি। কভারেজ আমি চাইও না। দি ইসু ওয়াজ ইমপরট্যান্ট। সেটা অস্তৃত কভার করা উচিত।ছল।
এজেন্সি আমাদের খবর দেয়নি তা হলে।
নিশ্চয়ই দিয়েছিল। পি টি আই, ইউ এন আই সকলে কভার করেছে। দেয়নি আমাদের দিল্লির করেসপন্ডেন্ট। আই হেট হিজ গাটস। তবে সনাতন মুখার্জিকে আমি চিনি। ওয়ান ডে উই উইল হ্যাভ এ শো-ডাউন।
সনাতনদার হয়তো দোষ নেই! খবরটা নিশ্চয়ই দিয়েছিলেন, নিউজ ডেসকে বাদ হয়ে গেছে।
তাই বা কেন হবে? নিউজ ডেসক কি ঘাস খায়? খবরের ইমপরট্যান্স বোঝে না?
আমি জেনে আপনাকে বলব মদনদা।
মদন দেখেছে, কনফ্রনটেশন দিয়ে দিন শুরু করলে তার দিনটা ভালই যায়। এইজন্য সে সকালের দিকে একটা ঝগড়া বা চেঁচামেচি বাঁধিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। আজ শচীকে ধমকে তার বউনি বোধহয় ভালই হল।
ভোটের সময় মদনের পক্ষে পাণ্ডা ছিল শ্ৰীমন্ত। এতক্ষণ বাইরের রাস্তায় সিগারেট খাচ্ছিল দু-তিনজনে মিলে। মদন বাইরের ঘরে এসেছে টের পেয়ে ঘরে ঢুকল। ঘরে একধারে একটা গদিআঁটা বড় সোফা, দুটো ছোট সোফা, কয়েকটা অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের পলিথিনের চেয়ার। সবটাতেই ঠাসাঠাসি ভিড়।
শ্ৰীমন্ত এসে মেঝের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে কানে কানে বলে, হালদারের সঙ্গে একটু কথা বলে যাবেন। সবার হয়ে গেলে। প্রাইভেট।
শ্ৰীমন্তের কথা মানতেই হয় মদনকে। শ্ৰীমন্ত তার ডান হাত। মদন নিচু গলায় বলে, ফালতু লোক কিছু কাটিয়ে দে।
হরিদা তার ছেলেকে মেডিকেলে ভর্তি করানোর কথা বলতে এসেছে। কাল আসতে বলে দিই?
দে।
আর জয়?
ও কী চায়?
কিছু বলেনি। তবে কিছু চায় নিশ্চয়ই।
কাটিয়ে দে।
তা হলে ওদের নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। দুপুরে কি প্রেস ক্লাবে আসতে হবে?
আসিস।
শ্ৰীমন্ত ওঠে। পেটানো বিশাল চওড়া তার শরীর। একবার তাকালেই তার পেশা সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। সে গিয়ে দরজার ভিড়টাকে প্রায় কোলে নিয়ে রাস্তায় নেমে গেল।
একটা চেনামুখের দিকে চেয়ে মদন হাসে, কী খবর?
আধবুড়ো সম্ভ্রান্ত চেহারার ভদ্রলোকটি কিছু তটস্থ হয়ে বলেন, রেল বোর্ডে আমার কেসটার কথা তুলবেন বলেছিলেন।
কাগজপত্র কিছু দিয়েছিলেন আমাকে?
দিয়েছিলাম। গত জানুয়ারিতে।
ওঃ, তা হলে হারিয়ে ফেলেছি। মাঝখানে ফিলিপিনস মালয়েশিয়া সব যেতে হয়েছিল ডেলিগেশনে। ফিরে এসে দেখি, ফাইলে অনেক কাগজপত্র নেই।
তা হলে?
একটা চিঠি করে দিয়ে দেবেন আমার কাছে। দেখব।
কথাটা ভাল করে শেষ করার আগেই বাঁ ধারের বুক কেসের কাছে দাঁড়ানো এক মহিলা বললেন, বাবা, আমার কথাটা একটু শুনে নেবে? বাড়িতে ছোট বাচ্চা রেখে এসেছি। দূরও অনেক, সেই বোড়াল।
বলুন।
আমি মন্টু হাটির মা।
ও। মন্টু কে যেন?
আমার ছেলে। ওই বড়। মেজো নব।
নব?
নীলু হাজরার খুনের দায়ে যে ছেলে জেল খাটছে।
মদন একটু নড়ে বসে, ও, তা কী চাই আপনার? নবর জন্য তো আর কিছু করার নেই।
তার বউ বাচ্চা সব আমার ঘাড়ে। মন্টু এক পয়সাও দেয় না। নব জেলে। আমি কী করে সলাই?
আর্নিং মেম্বার কেউ নেই?
না। নবর বউ একটা সেলাই স্কুলে কাজ করে। কিছু পায়। তাতে হয় না।
আমাকে কী করতে বলেন?
নবর অফিসে যদি ওর বউয়ের একটা চাকরি হয়।